আলেপ্পোয় শিশুদের মারা হচ্ছে

পাঠক, আমাকে বীভৎস বর্ণনা দিতে হচ্ছে, আপনারা পড়ুন। কিন্তু দুঃখজনক প্রতিবেদনটি হচ্ছে, এই মানুষেরা পূর্ব আলেপ্পোর ‘বিদ্রোহীদের’ বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে। এই শিশুরা পশ্চিম আলেপ্পোয় নিহত হয়েছে, শহরের যে অংশটা সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে কারণে নিহত শিশুদের নাম জানা যাবে না। আর আহত ব্যক্তিদের যন্ত্রণার কথাও আপনাদের কানে পৌঁছাবে না। আল রাজি হাসপাতালে যে শিশুটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, চিকিৎসক যার মুখ থেকে স্কালপেল দিয়ে একটি ধাতুর টুকরা বের করছিলেন, তার কষ্টের কথা আমরা জানতে পারব না।

আমি যে বর্ণনা দেব, তাতে কিন্তু পূর্ব আলেপ্পোর মানুষের ওপর পরিচালিত সিরিয়া ও রাশিয়ার বোমাবর্ষণজনিত বর্বরতার ভার লাঘব হবে না, যদিও উল্লিখিত হামলা চালিয়েছে বিদ্রোহীরা। ওই ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুলের সামনে আমি যখন সিরিয়ার এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি বিদ্রোহীদের একধরনের প্রতিশোধ? তখন তিনি আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি চিৎকার করে ওঠেন: ‘না, না, না, তারা এর আগেও স্কুলে হামলা চালিয়েছে। তারা স্রেফ পশু। তারা জানে না, শৈশব কী জিনিস। আমরা যখন গত সপ্তাহে পূর্ব আলেপ্পোর মানুষের যাতায়াতের রাস্তা খুলে দিয়েছিলাম, তখন আমরা এই স্কুলগুলোকেও উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম।’

বেসরকারিভাবে পরিচালিত ন্যাশনাল স্কুল অব আলেপ্পোর ছাদের একটি কোনায় প্রথম বোমাটি আঘাত করে ঠিক
বেলা ১১টায়। এতে ছাদে যে পরিখা ছিল তার সামনের বাঁধ ও স্কুলের আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বালক স্রেফ উড়ে গেল। আমি যখন সেখানে গেলাম, পুলিশ তখন লাশগুলো নীল কাপড়ে ঢেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল। এদের একজন ছিল ১৫ বছর বয়সী ওমর দিয়েরি। সঙ্গে ছিল ১৫ বছর বয়সী আরও এক বালকের লাশ, যার নাম ইমাদ সাবাগ। তৃতীয় আরেকজনের পরিচয় তখনো জানা যায়নি। কথা হচ্ছে, এটি শহরের বেসরকারি স্কুল হওয়ায় অভিভাবকেরা সবাই সুবেশী ছিলেন। তাঁরা ধারণাও করতে পারেননি, তাঁদের পরিবার সহিংসতার শিকার হবে। আমি যখন স্কুলে গেলাম, এই অভিভাবকেরা কাঁদতে কাঁদতে স্কুলের দিকে আসছিলেন।

স্কুলের যে দিকটাতে বোমা পড়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে বোমাটা পূর্ব দিক থেকে ছোড়া হয়েছে। আবার এটাও নিশ্চিত, সরকারের পেতে রাখা গোপন বোমাও ছিল না এটা। প্রচারণা পাওয়ার জন্য সরকার কখনো কখনো যা করে থাকে। জাবাত আল-নসুরা বা তার মিত্ররা এই বোমা ছুড়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ৯/১১-এর হামলাকারী কুখ্যাত আল-কায়েদা নাম পরিবর্তন করে জাবাত আল-নুসরা হয়েছে, পশ্চিম যাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে বিদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দেয়। বোমাটা পশ্চিম আলেপ্পোর একটি আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল, ঠিক যেমন দ্বিতীয় বোমাটা হামদামিয়েহ্ শহরের এই অ্যাপার্টমেন্টে এসে পড়ে।

রাজি মেডিকেল সেন্টার থেকে এক মাইল দূরের ইউনিভার্সিটি হসপিটালে এলাম। সেখানে তখন কেবলই তিনটি মরদেহ আনা হয়েছে। এরা সবাই বাসায় সকালের নাশতা খাওয়ার পর নিহত হয়েছে। একজনের নাম খানম ফালাহ্, তার বয়স মাত্র দুই বছর। দেখলাম, একটি ট্রলির ওপর সে শুয়ে আছে, তার মুখটা ধুলায় ধূসর হয়ে গেছে। খানিকটা ডান দিকে কাত হয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন ঘুমাচ্ছে। ওর পেছনে দুই ভাইয়ের মরদেহ। একজন ১০ বছরের খলিল, আরেকজন ১১ বছরের খালেদ।

তাদের মধ্যে একজন সিলিংয়ের দিকে মুখ করে অনেকটা বেয়াড়া ভঙ্গিতে শুয়ে ছিল, ঠিক কে এখন তা মনে পড়ছে না। আর আমরা যেহেতু মানুষ, তাই নানা সাধারণ চিন্তা মাথায় ঢুকতে শুরু করে। হ্যাঁ, খানমের মা দুনিয়ায় ওর শেষ দিনে এভাবে ওকে সাজিয়েছিলে​ন। এই জামা পরেই ও সকালের নাশতা খাচ্ছিল…আর এখন সিরিয়ার আরও হাজারো শিশুর মতো সে–ও মরে গেছে, যে পৃথিবীকে ভালোভাবে জানতেই পারল না। সে এখন কেবলই এক হাস্যকর পরিসংখ্যানের অংশ, যদিও এই যুদ্ধে নিহত মানুষের প্রকৃত পরিসংখ্যান আমরা কখনোই জানতে পারব না। আজ রাতে তাকে মাটিতে শায়িত করা হবে।

ব্যাপারটা কি আবেগময় হয়ে গেল? আমি তা মনে করি না। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা পূর্ব আলেপ্পোর মৃত শিশুদের নিয়ে আমরা বিলাপ করি। কিন্তু খানমের প্রতিও পৃথিবীর একই সমবেদনা জানানো উচিত। খানম, তার ভাই বা ওই তিন শিশুর কেউই ঠিক করেনি যে আলেপ্পোর কোন অংশে তারা থাকবে। বেঁচে যাওয়া শিশুদের সঙ্গে আলাপ করলে সব সময়ই আপনি ধাক্কা খাবেন, আবার বিস্মিতও হবেন। ১৪ বছরের আহমেদ পায়ে রক্ত নিয়ে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আমাকে বলে, বোমাটা যখন ওই ছাদে পড়ে, তখন সে ক্লাসেই ছিল। তবে অবিশ্বাস্যভাবে আহমেদ একদম নিখুঁত ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করল, ‘আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধুরাও মেঝেতে পড়ে গেল। নিজের চোখে দেখলাম, বন্ধুরা মারা গেল। আমি এর চেয়ে বেশি মনে করতে পারি না। আমি ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম।’

এ সময় এই আহত সেনাকে নিয়ে আসা হলো। তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। তাঁর শরীর থেকে ব্যান্ডেজ খসে পড়ছিল। এর মধ্যে অন্য সেনারা লোকজনকে পাশে সরিয়ে দিলেন। চিকিৎসক চিৎকার করে বলে উঠলেন, তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আনা হয়েছে। তার মানে, পশ্চিম আলেপ্পোর ওই মৃত শিশুদের সঙ্গে এখন বাশার আল-আসাদের এক আহত সেনাকেও হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। তবে এই হাসপাতাল এমন সময়ে খোলা হয়েছিল, যখন কেউ যুদ্ধের কথা কল্পনাও করতে পারেনি।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি