আলো থেকে আঁধারের অভিমুখ

১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতনের ভেতর দিয়ে আধুনিক যুগের মানস অন্ধকার থেকে আলোর পথযাত্রী হয়। ভারতবর্ষে একদল ধর্মের রাজনৈতিক কারবারির হাতে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধুলোয় মিশে যায়। এই দিন কেবল আধুনিক ভারতেরই নয়, আধুনিক বিশ্বেরও আলো থেকে অন্ধকারের কালগর্ভে আত্মবিসর্জনের এক আত্মধিক্কৃত বিভীষিকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই কালপর্ব স্বাধীন ভারতকে স্বার্থান্বেষীদের ক্রূর অভিসন্ধি পূরণের একটি সময়ক্ষেপণ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। ২৫ বছর ধরে যে অস্থির ভারত আমাদের চেতনাকে বিদ্ধ করছে, আমাদের বোধের তন্তুগুলোকে ছিন্ন করছে, তার কালসর্প আমাদের সমাজ-জীবনে প্রবেশ করেছিল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ভেতর দিয়ে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসটি কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের উপাসনালয়কে মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া নয়, ওই ঐতিহাসিক উপাসনালয়টির ধ্বংসের ভেতর দিয়ে দস্যুরা হত্যা করেছে যুগ যুগ ধরে আমাদের এই প্রিয়তম দেশটির মর্মবাণী সহিষ্ণুতা, প্রেম, ত্যাগের আদর্শকে। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে—এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’-র যে মর্মবাণী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চারণ করেছিলেন, তাকে সমূলে উৎপাটনই ছিল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ভেতর দিয়ে ধর্মের নাম করে একদল বর্বর দস্যুর মূল অভিসন্ধি।

এই তমসামগ্ন দিনটির দিনাঙ্ক ফিরে এলেই আজও যাঁরা চিরন্তন ভারতকে ভালোবাসেন, বুকের ভেতরে লালন করেন ‘শক হূণদল পাঠান মোগল এক দেহে হলো লীন’-এর ভারতবর্ষকে, সেসব মানুষ যন্ত্রণায় ক্লিন্ন হয়ে পড়েন। চোখের সামনে যুগ যুগ ধরে প্রবহমান সহিষ্ণু ভারত-আত্মার এই পরিকল্পিত হত্যায় তাঁরা শিউরে ওঠেন। তাঁদের অন্তরাত্মা ‘নবজীবনের গান’-এর মতোই চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘না না না। মানব না। কোটি মৃত্যুকে কানে নেব প্রাণপণে। ভয়ের রাজ্যে থাকব না।’

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করে ভারতবর্ষকে একটা অন্ধকারের ঘন আবর্তে ঠেলে দিতে চেয়েছিল অসভ্য বর্বর হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। দুর্ভাগ্য ভারতবাসীর, সেই দুরভিসন্ধিকে ঠেকানো যায়নি। বাবরি ধ্বংসের চিতাগ্নির ছাই মেখেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে সাফল্য পায় আশাতীত রকমের। এই সাফল্যকে সংযত করে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করে আরএসএস। সংঘের সাম্প্রদায়িক অভিমুখে এতকাল যে গোপনীয়তা ছিল, তার চরিত্রেও একটা অদলবদল ঘটতে শুরু করে বাবরি ধ্বংসের পর থেকে।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে নিজেদের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার চরিত্রে পরিবর্তন আনার ভাবনা শুরু করে আরএসএস। সেই লক্ষ্যে হিন্দু মহাসভার রাজনৈতিক চরিত্র কৌশলগত কারণে কিছুটা লুকিয়ে তাদের সামাজিক সংগঠন হিসেবে মেলে ধরার চেষ্টা করে সংঘ। হিন্দু মহাসভাকে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তারা তুলে ধরতে চায়। বস্তুত, গান্ধী হত্যায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রত্যক্ষ ভূমিকা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্য খাতে ঘুরিয়ে দেওয়া ছিল আরএসএসের লক্ষ্য।

এই সময়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা নিজেদের যাবতীয় কার্যক্রমকে পরিচালনা করত একটা চরম গোপনীয়তার ভেতর দিয়ে। সেই সময়ে তাদের প্রকাশ্য কর্মসূচি প্রায় দেখতেই পাওয়া যেত না বলা যেতে পারে। আরএসএস গোপনীয়তা বজায় রাখত আর তাদের শাখা সংগঠনগুলোর কিছু কিছু প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন করত। মোরারজি দেশাই সরকারে বাজপেয়ি, আদবানি মন্ত্রী ছিলেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি একদিকে প্রশাসনের ভেতরে অনুপ্রবেশ করে, অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের শাখা সংগঠনগুলোকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। বস্তুত আরএসএস তাদের কার্যক্রমকে এভাবে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’র প্রসার ঘটাতে শুরু করে।

১৯৮০ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী আরএসএস তাদের নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি তৈরি করে। দেশাই সরকারে থাকার দরুন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তখন বেশ ভালোভাবে প্রশাসনের ভেতরে নিজেদের প্রভাবকে বিস্তার করতে পেরেছে। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসার পরও প্রশাসনের একটা স্তরে আরএসএসের ব্যাপক প্রভাব থেকে যায়। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকেই সংঘের প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারদের একটি অংশ এই প্রসঙ্গে ইন্দিরার জরুরি অবস্থা জারির অন্যতম কারণ হিসেবে আরএসএসের ভূমিকার কথা বলে থাকে। ইন্দিরা বা তাঁর কাছের লোকজনও জরুরি অবস্থা জারির পেছনে আরএসএসের কথা বলেন। জরুরি অবস্থার সময়ের গোয়েন্দাপ্রধান টি ভি রাজেশ্বর, যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়েছিলেন, তিনিও জরুরি অবস্থা জারির প্রশ্নে শ্রীমতী গান্ধীর আরএসএসের ভূমিকা ঘিরে সংশয়ের কথা বলেছেন।

১৯৮০-র দশকে শ্রীমতী গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসেন। দেশাই সরকারের আমলে সংঘ খানিকটা নিজেদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। ইন্দিরার প্রত্যাবর্তনের ফলে সংঘ আবারও তাদের গোপনীয়তার বেড়াজালের ভেতরে ঢুকে পড়তে শুরু করে। গোপনীয়তার বেড়াজালে ঢুকে নিজেদের কার্যকলাপকে আড়াল করলেও তাদের কার্যক্রম কিন্তু এতটুকু কমল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংঘের শাখা সংগঠন ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’ কেন্দ্রে দেশাই সরকারের আমলে বেশ ভালোভাবে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছিল। ১৯৮০ সালে শ্রীমতী গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ওই সংগঠনটি অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশে তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ না রেখে হিন্দি বলয়ে নিজেদের ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি জোরদারভাবে চালাতে থাকে।

জরুরি অবস্থা জারির জন্য শ্রীমতী গান্ধী যেমন আরএসএস কার্যকলাপ বৃদ্ধিকে নিজের পক্ষের যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, তেমনিই জয়প্রকাশ নারায়ণের জরুরি অবস্থাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে নিজেদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাটাকে বাড়িয়ে নিয়েছিল আরএসএস। গান্ধী হত্যার সঙ্গে যুক্ত আরএসএস সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের কাছেই তখন ব্রাত্য ছিল। জয়প্রকাশ নিজেই গান্ধীজি শহীদ হওয়ার পর তাঁর প্রাণরক্ষায় দেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত দাবি করেছিলেন। সে সময়ে আরএসএসের ভূমিকা নিয়েও জয়প্রকাশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। সেই জয়প্রকাশই ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগে জরুরি অবস্থাবিরোধী আন্দোলনে আরএসএসকে নিয়ে তাদের একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা করে দেন। এই সুযোগের অপেক্ষাই আরএসএস করছিল।

ক্ষমতা হারিয়ে জরুরি অবস্থার ভয়াবহ স্মৃতিকে মানুষের মন থেকে মুছে দিতে শ্রীমতী গান্ধী যে পথ অনুসরণ করেন, তাতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিই আরও ক্ষমতাশালী হয়। দেশাই সরকারের প্রথম বছর অতিক্রান্ত হওয়ার ভেতরেই তিরুবনন্তপুরমে একটি ধর্মান্তরিতকরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন শ্রীমতী গান্ধী। এই ঘটনা একই সঙ্গে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে দুটি দিক নির্দেশ করে। প্রথমটি হলো আরএসএসের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির যে অজুহাতকে জরুরি অবস্থা জারির বাধ্যবাধকতা বলে শ্রীমতী গান্ধী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে প্রচার করা হয়, তার কোনো সারবত্তা নেই। দ্বিতীয় হলো খাতায়-কলমে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা শ্রীমতী গান্ধী বা কংগ্রেস দলের সুবিধাবাদী নীতি ও অবস্থান রামমন্দিরকে ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সংহত হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।

বস্তুত, নরম হিন্দুত্বের পথকে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য ব্যবহার করে সেই সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি থাকা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে যে বোঝাপড়ার ইঙ্গিত শ্রীমতী গান্ধী দিয়েছিলেন, তাঁর ছেলে রাজীব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং পরিপক্বতার অভাবে নিজের দলের স্বার্থে সেভাবে ব্যবহার করতে পারেননি। শ্রীমতী গান্ধীর আমলেই ১৯৮০-র দশকে ধর্ম সংসদ নামক সাম্প্রদায়িক জমায়েত করে আরএসএস। শ্রীমতী গান্ধী আদৌ কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেন। এতে সমস্যার আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে।

ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি সংসদীয় রাজনীতিতে খুব কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সংসদে তাদের সদস্যসংখ্যা মাত্র দুইয়ে নেমে আসে। তাদের প্রথম সারির সব নেতাই পরাজিত হন। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে একদিকে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে একটি জ্বলন্ত সমস্যাতে ঘৃতাহুতি দেন। অন্যদিকে, ‘মাচানবাবা’ ইত্যাদির কাছে মাথা নুইয়ে নিজের চরম প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতাকে স্পষ্ট করে তোলেন। যে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অস্মিতার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে শ্রীমতী গান্ধীকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল, বস্তুত সেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে আপসের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করেন রাজীব। ভয়ংকর রকমভাবে আপস করেন মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে।

শাহবানু মামলার রায় প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বানচাল করতে রাজীব আত্মসমর্পণ করেন মুসলিম মৌলবাদী শক্তির কাছে। সংখ্যালঘু মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে আপস করে তিনি প্রবর্তন করেন ‘মুসলিম নারী অধিকার রক্ষা বিল’। এই আইনকে ঘিরে দেশের মানুষের প্রবল বিক্ষোভের পাশাপাশি রাজীবের দলের ভেতরেও ক্ষোভ চরমে ওঠে। পদত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য আরিফ মহম্মদ খান। তিনি সেই সময়ে দেশের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কতিপয় মৌলবাদীর অভিমতকে সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজের অভিমত মনে করে নিজের দলের সুস্থ চিন্তাকে গুরুত্ব দেননি রাজীব। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মদমত্ততায় তিনি হিন্দু ও মুসলিম—উভয় মৌলবাদী শিবিরকেই প্রশ্রয় দিয়ে কিছুটা হলেও ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পটভূমিকে ত্বরান্বিত করে গেছেন।

ভি পি সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। মোরারজি দেশাইয়ের আমলে নিজেদের লোক সরকারে থাকার ফলে প্রশাসনের ভেতরে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবেশ ঘটাতে আরএসএস সফল হয়েছিল। তেমন প্রবণতা ভি পি সিংয়ের আমলে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সরকারের বাইরে রেখেও আরএসএস করেছিল। তবে তেমন একটা সফল হয়নি। আরএসএস এবং বিজেপির প্রশ্নে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংয়ের অবস্থানের ভেতরে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। কোনো অবস্থাতেই তিনি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে নাক গলাতে দেননি। বিষয়টাকে সহজভাবে সংঘ ও বিজেপিও মেনে নিতে পারেনি। সংঘ প্রত্যাঘাত করার সব রকমের চেষ্টা করেছে।

বিজেপির সাম্প্রদায়িক অভিমুখের মোকাবিলাতে ভি পি সিং মণ্ডল কমিশনের অভিমতকে সামনে নিয়ে আসেন। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের চিরাচরিত সমর্থক গোষ্ঠী উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাতদের মণ্ডল কমিশনের অভিমতের বিরুদ্ধে আড়াল থেকে খেপিয়ে দেয়। জাতপাতের নিরিখে সে সময়ে একটা ভয়বহ মেরুকরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়। উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাতরা জুতো মেরামত ইত্যাদি প্রতীকী অবস্থানের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার করে দেয় দলিত সমাজের প্রতি তাদের মানসিকতাকে। এই পর্যায়ে গুজরাট, রাজস্থান ইত্যাদি দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে একদিকে উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাতদের দলিতদের বিরুদ্ধে আড়াল থেকে খ্যাপাতে থাকে সংঘ ও সংঘ পরিবার এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। অন্যদিকে, বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীরা খ্যাপাতে থাকে দলিত আদিবাসীদেরও।

ভি পি সিংয়ের মণ্ডল কমিশনজনিত বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পথে হাঁটে না হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। সংসদে তাদের সংখ্যার নিরিখে তারা তখন প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বস্তুত, বোফর্স, হাউৎজার সাবমেরিন ইত্যাদি দুর্নীতির প্রশ্নে রাজীববিরোধী কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক বিরোধী শিবিরে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির থাকার সুযোগটা নিতে ছাড়ে না আরএসএস। নির্বাচনী সাফল্যকে মাথায় রেখে মণ্ডল কমিশনজনিত পরিস্থিতিতে ভি পি সিংয়ের পালে তৈরি হওয়া হাওয়াকে কেড়ে নিতে সাম্প্রদায়িক শিবির তাদের চিরাচরিত সাম্প্রদায়িক তাসটিকে আস্তিনের ভেতর থেকে বের করে। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে যে ঝিমিয়ে পড়া বিতর্ককে উসকে দিয়েছিলেন রাজীব, তাকেই কাজে লাগায় গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেই জায়গাতেই রামমন্দির তৈরির জন্য তারা শুরু করে পূজা, যার পোশাকি নাম তারা দিয়েছিল ‘শিলাপূজা’।

ভি পি সিং এবং তাঁর সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কংগ্রেস সে সময়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির এই কর্মকাণ্ডকে বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়ে নিজেদের কর্তব্য সেরেছিল। বামপন্থীরা বাদে ভি পির সরকারের শরিক, সমর্থকদের ভেতরে কোনো মতাদর্শগত তাগিদ না থাকায় অঙ্কুরেই সেই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির বিনাশ ঘটানোর লক্ষ্যে সে সময়ে কোনো রাজনৈতিক দলের ভেতরেই আন্তরিকতা দেখা যায়নি। কংগ্রেস তখনো রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তি রাখত। ইটপূজা বা পরবর্তীকালে আদবানির তথাকথিত রথযাত্রার প্রতিবাদে তারা আদৌ আন্তরিক ছিল না। অঞ্চলবিশেষে, এমনকি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রচ্ছন্নভাবে মদদ জোগানোর মতো অভিযোগও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে উঠেছিল। এই সামগ্রিক পটভূমিতেই পি ভি নরসীমা রাওয়ের অবিমৃশ্যকারিতায় বাজার অর্থনীতির মতো এক তমসাচ্ছন্ন ভারতের দিকে পশ্চাদপসরণের সূচনা। বাজপেয়ি সেই পেছন দিকে হাঁটাকে আরও ত্বরান্বিত করে গেছেন। বুঝি-বা মোদি তাঁকে সম্পূর্ণ ধসের দিকেই ঠেলে দেবেন।

গৌতম রায়: ভারতীয় গবেষক ও ইতিহাসবিদ।