আশাবৃক্ষের নাম ‘নারীমুক্তি’

নারীর অধিকার মূলত মানুষের অধিকার। অর্থাৎ নারী মানুষ। মানুষ ব্যক্তিগত অধিকারের নিশ্চয়তা চায়, যা নারীর ক্ষেত্রে একই। সন্ত্রাসমুক্ত থাকা, বৈষম্যের শিকার না হওয়া, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রত্যাশা, শিক্ষা ও নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহের নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুব্যবস্থা এবং সর্বোপরি শ্রমের সঠিক মূল্যপ্রাপ্তি যেমন যেকোনো মানুষের অধিকার, তেমনি নারীরও। তবে কেবল নারী অধিকারকে পৃথক করে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে কেন?

কারণ খুঁজতে পরিশ্রম করতে হয় না। আইনকানুন নারীকে জমি ও সম্পদ-সম্পত্তিতে পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে দেয় না। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য তাঁকে বাড়িতে ও বাইরে নির্যাতিত হতে বাধ্য করে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাঁকে পণ্য হিসেবে চালান হতে হয়। ৩০ শতাংশ নারীকে কেবল লৈঙ্গিক কারণে প্রত্যক্ষভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় তাঁদের যৌনতা কিংবা জননপ্রক্রিয়ার স্বাধীনতা থাকে না। আর এসব কারণে অধিকারের প্রশ্ন তুললে নারী সাধারণত ধর্ম, তথাকথিত মানসম্মান ও সমাজের পরম্পরার চোখে এক ‘হুমকি’ হিসেবে উপস্থিত হয়।

বেশি দিন হয়নি যে নারীর প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ জাতিগতভাবে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেছে। এই তো, মাত্র ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের এক কনভেনশনে নারীর প্রতি অবমাননা ও সন্ত্রাসকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ওঠে। কিন্তু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রণয়ন করলেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। কঠিন বাস্তবতায় নারীর অস্তিত্ব প্রকাশ্যে সমাজের দ্বিতীয় স্তরে আটকে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ‘সর্বস্তরে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত’ হওয়ার ভাবনা এক তামাশাই বটে। যেখানে সমাজে নারী এখনো সম্পদের মালিকানার অধিকার, রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার, এমনকি নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণের অধিকার পরিপূর্ণভাবে হাতে পাননি, সেখানে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা যেন আজীবন অলীক কল্পনা থেকে যায়।

যুগ যুগ ধরে মনে করা হয় নারী শারীরিকভাবে দুর্বল। জন্ম থেকে নারীকে এই বিশ্বাস এ জন্যই দেওয়া হয় যেন তাঁর ওপর জোর খাটানো সহজ হয়। অথচ যেকোনো শারীরিক কাজের জন্য নারী নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন, তার প্রমাণ আছে বিশ্বজুড়ে। আমাদের দেশে কৃষি, নির্মাণশিল্প ও তৈরি পোশাকশিল্পে নারীর ব্যাপক উপস্থিতি সেই কথাই বলে। নারীর বিবেচনাবোধ নিয়েও সংশয় থাকে, তাই তো মাত্র একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর মতের তোয়াক্কা করার কথা ভাবা হয়। ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে নারীরা প্রথম জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা সে অধিকার পান ১৯২০ সালে এবং ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে। তবে এত বছর চেষ্টা চললেও বিশ্বের সবখানে নারীর রাজনৈতিক মতামতের মূল্য এখনো নেই; সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম থেকে নারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তানের কিছু স্থানে এখনো নারীর ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ। অন্যদিকে আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্তি পেতে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার আগেই ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। কিন্তু আফ্রিকাসহ পৃথিবীর কোথাও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি পুরোপুরিভাবে ঘটেনি। নারীর আপন পরিবার এবং মোটাদাগে চেনা সমাজ পদে পদে তাঁকে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

এসব প্রতিকূলতার মাঝখানে নারী যখন সামান্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চান, তখন স্থান ও সংস্কৃতিভেদে বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, অনিচ্ছাকৃত সন্তানধারণ, এসবের সঙ্গে সমসাময়িক কালে যোগ হয় জবরদস্তিমূলকভাবে কন্যাশিশু ভ্রূণ হত্যা, এইডস কিংবা পাচার।

প্রকৃতপক্ষে নারী নিজের শরীরের ওপরেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। ফলে নারীর অর্থনৈতিক শৃঙ্খল ও সামাজিক নিগ্রহের ঊর্ধ্বে ওঠা হয় না। আর সে কারণেই যুগ যুগ ধরে নারী অধিকার আন্দোলনে তাঁর অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমাজে পুরুষের সমান গ্রহণযোগ্যতা, বিশেষ করে শ্রমের মূল্যের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান হওয়ার লড়াই চলে। বস্তুত এই অধিকারগুলো নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নারীর নিজের শরীরের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

উপরন্তু, নারীর মুক্তি এক অর্থে গণতন্ত্রের মুক্তি। গণতন্ত্রে লিঙ্গ-জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার প্রতি সমতা বিধানকে লক্ষ্য ধরে নেওয়া হয়। নারী যত দিন পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষের অধস্তন থাকবেন, তত দিন দেশে বা রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে অন্তত ২২টি দেশ নারীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। অভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে নারী ও পুরুষ একই মাত্রার যোগ্যতার পরিচয় দিতে সক্ষম।

ক্ষুদ্র থেকে জাতীয়, যেকোনো পরিসরে নারী নিজেকে বারবার প্রমাণ করার পরও বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় গড়ে কেবল ২৫ শতাংশ আসনে নারীর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেহেতু নেতৃত্বের অবস্থানে তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি কম, তাই আইনকানুন প্রণয়নে তাঁদের জরুরি প্রয়োজন গুরুত্ব পায় না। ধারণা করা হয়, ক্ষমতা পরিচালনায় নারীর উপস্থিতি একই হারে ক্রমবর্ধমান থাকলে সমতা আসতে ১২৯ বছর (২১৫০ সাল) লাগবে। নারীর প্রতি নির্ভরতার অভাবজনিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা তাঁর ক্ষমতায়নে প্রধান বাধা। অন্যদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতি কেবল মুনাফার ওপরে মনোনিবেশ করে। এমতাবস্থায় সাধারণ দ্রব্য উৎপন্নের কারখানা থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র, প্রতিটি ব্যবসা পুরুষের তুলনায় নারীকে শ্রমের মূল্য কম প্রদান করে মুনাফা বাড়াতে চায়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ, দুই–ই নারীর মুক্তির অন্তরায়।

২০২০ সালে পৃথিবীময় আলোচিত ৫০০ ব্যবসার মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশের কর্ণধার নারী। বড় ব্যবসায় নারীর ওপর নির্ভরশীলতার মানসিকতা পরিবারে ও সমাজে এখনো সম্পূর্ণভাবে আসেনি। তবে খেলার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। ২০২০ সালের বাতিল হওয়া অলিম্পিক গেমসকে প্রথম লৈঙ্গিক ভারসাম্যের খেলা বলা যায়, যেখানে ৪৯ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে উপর্যুপরি রেকর্ড ভাঙার পরও সুনির্দিষ্ট খেলা থেকে নারীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় ভাতা ও পুরস্কার নারীকে কম প্রদান করা হয়েছে।

চলমান কোভিড–১৯ অতিমারি আমলে রেখে বলা যায়, বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে কর্মীদের ৭০ শতাংশ নারী, অথচ একই খাতে নেতৃত্বের মাত্র ৩০ শতাংশ আসনে নারীর উপস্থিতি দৃশ্যমান। পরিস্থিতিটি নেতৃত্বের প্রশ্নে নারীর নাজুক অবস্থানের পরিচায়ক। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের নারী দিবস সামনে রেখে জাতিসংঘ, ‘নেতৃত্বে নারী: কোভিড–১৯ আক্রান্ত পৃথিবীতে সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক ঘোষণা দিয়েছে। অতিমারির বিরুদ্ধে সংগ্রামে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সেবক, সাংগঠনিক নেতা, জাতীয় নেতাসহ বিভিন্ন ভূমিকায় নারী তাঁর যোগ্যতা অতিমাত্রায় স্পষ্ট করেছেন। জাতিসংঘের এই ঘোষণা তারই উদ্‌যাপন। অন্যদিকে অতিমারিকেন্দ্রিক পরিস্থিতিতে নারীর ওপর দাপ্তরিক ও সাংসারিক অসম দায়িত্বের বোঝা আরও বেশি আলোচনায় এসেছে। আবার ঘরবন্দী অবস্থায় তাঁরা নির্যাতিতও হয়েছেন আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তদুপরি নারী অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রশংসাযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। উল্লেখ্য, নারী নেতৃত্বের দেশগুলো, যেমন ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, আইসল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং বাংলাদেশে তুলনামূলক সুষ্ঠুভাবে কোভিড মোকাবিলা করতে দেখা গেছে।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি থেকে চোখ সরিয়ে যদি সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে তাকানো যায়, নারী অধিকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি একে অন্যের পরিপূরক নয়? নারী অধিকার নিশ্চিত হলে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে নাকি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে নারী অধিকারের নিশ্চয়তা আসে—এ নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। ইতিহাস বলে, যেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে, উন্নয়নের আগে সেখানে নারী অধিকার তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অন্যদিকে নারী অধিকার নিশ্চিত হলে স্বাস্থ্য ও শিশু খাতে অর্থের জোগান বাড়বে, যা সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। একইভাবে সামাজিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন পিতৃতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থায় পরিবারের অর্থের চাহিদা বাড়ায়। তাই স্বাভাবিকভাবে ব্যয় বহনের তাগিদে নারী অধিকারের প্রসঙ্গ প্রকট হয়ে ওঠে।

তারপরও, সমাজে কী দুর্বিষহ অবস্থান নারীর। চলাচলের স্বাধীনতা নেই, পদে পদে বিপদ। শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্র, সবখানেই নির্যাতন-ধর্ষণের আশঙ্কা তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। তবু সেই পৃথিবীতেই তাঁকে অবস্থান করতে হয়, বেড়ে উঠতে হয়, ধর্ষণ যেখানে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের স্মারক, যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যতম অস্ত্র। তবে নারী দমে যান না। নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শারীরিক মুক্তির সংগ্রাম ক্রমেই বলীয়ান হতে থাকে। বছরে বছরে নারী দিবস এসে আশাবৃক্ষটির গোড়ায় আরেকটু জল ঢালে।

আফসানা বেগম: কথাসাহিত্যিক