আসামি নিয়ে পুলিশ যাবে কোন কোর্টে

মাদকবিরোধী তৎপরতার অংশ হিসেবে যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলে, সে দেশে মাদক অপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের ধারণা সংসদে পরিত্যক্ত হলো। এমন উদাহরণ সম্ভবত এই প্রথম। এটা মাদক অপরাধীদের জন্য ‘সুখকর’, জনগণের জন্য দুশ্চিন্তার। বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে অনীহার কারণেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো না।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন না করে মাদক মামলার বিচার বন্ধ থাকার পরিস্থিতিতে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। এক বছর আগের রায়ে বলেছিলেন, এটা ‘অনভিপ্রেত, দুঃখজনক এবং হতাশাজনক’। ট্রাইব্যুনাল না করা পর্যন্ত প্রচলিত আদালতে বিচারের সুযোগ তৈরিতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। রায়ের প্রতি সরকারি উদাসীনতার বিলোপ ঘটল তবু। এভাবে আমরা দেখি, মাদকের মতো স্পর্শকাতর অপরাধের বিচারে রাষ্ট্রের আগ্রহ নেই, বরং আগ্রহ আছে সন্দেহভাজন মাদক অপরাধীদের মেরে ফেলার।

মোবাইল কোর্টে মাদকসংশ্লিষ্ট আসামিদের পুলিশের ‘চালান’ দেওয়ার আগ্রহ ক্রমবর্ধমান। ২০১৮ সালের মাদক আইনেও মোবাইল কোর্টের জন্য আলাদা বিধান করা হয়েছে। তাই বিষয়টি খোলাসা করা দরকার। ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনটি নিয়ে তাই কিছু কথা বলাটা এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মোবাইল কোর্টকে হাইকোর্ট অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলেছেন, সেই যুক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।

ইতিমধ্যে মাদক মামলার বিচারে কতগুলো বিপজ্জনক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো পুলিশের চোখে মোবাইল কোর্ট যেন এখন সংবিধানে বর্ণিত ‘সাব–অর্ডিনেট কোর্টস বা অধস্তন আদালত’-এর অংশ। সংবিধানের ১১৪ অনুচ্ছেদ বলেছে, আইন দিয়ে অধস্তন আদালত তৈরি করতে হবে। অথচ ২০০৯ সালের আইনে মোবাইল কোর্টকে অধস্তন আদালত বলা হয়নি। সংবিধান আরও বলেছে, বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটরা সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ বলেছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করবে। এই ম্যাজিস্ট্রেট কোনোভাবেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশ কাউকে আটক করার পর অভিযুক্তকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি ঘটনাস্থল ছাড়া পরে ‘শুনানি’ করে কাউকে দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেই। বরং আইন তা নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু পুলিশ ক্রমবর্ধমান হারে মাদকের আসামি ধরে মোবাইল কোর্টে তুলছে।

২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইন বলেছে, ‘জনস্বার্থে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর ও অধিকতর দক্ষতার সহিত সম্পাদন করিবার জন্য এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে কতিপয় অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে গ্রহণ করিয়া দণ্ড আরোপের সীমিত ক্ষমতা অর্পণ করিয়া মোবাইল কোর্ট পরিচালনার লক্ষ্যে বিধান করা হল।’ এখন মাঝেমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ মাদক ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধের দায়ে অভিযুক্তকে আটক করে। পরদিন তারা নিকটস্থ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে এবং তাদের দণ্ড দেওয়া হয়। সেখান থেকে কারাগারে চালান করা হয়।

সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ বলেছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করবে। এই ম্যাজিস্ট্রেট কোনোভাবেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশ কাউকে আটক করার পর অভিযুক্তকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

তবে ২০১৮ সালের মাদক আইন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, এখন থেকে মূল আইনেই দুই ধরনের বিচার তৈরি করা হবে। দেশে মাদক অপরাধের বিচারে এখন আইনসম্মতভাবেই দুই রকমের বিচার। একাংশ সরকার চালায়। অন্যটি যথারীতি উচ্চ আদালত। তবে মোবাইল কোর্টে মাদক অপরাধের বিচার ছাড়া যদি এই জাতির মুক্তির উপায় সত্যি না থাকে, তাহলে আর রাখঢাক করে কী লাভ। যদি মোবাইল কোর্ট দিয়ে মাদকসহ অন্যান্য অপরাধের বিচারকার্য চালাতেই হয়, তাহলে আইনে উপযুক্ত সংশোধনী আনা হোক। প্রচলিত আইনে নির্দিষ্টভাবে বেআইনি বলে যা নিষিদ্ধ থাকবে, সেটা কতিপয় পুলিশ এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা আইনি বলে পরিচালনা করবেন, এতে কার কী লাভ, সত্যি সেটা বুঝতে পারি না।

যদি প্রশাসন ক্যাডার দিয়ে বিচারকার্য করাতেই হয়, তাহলে মোবাইল কোর্ট কেবল ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করিবার সময়’ চলবে, সেটা আইন থেকে তুলে দিন। এ কথাও তুলে দিন যে তাঁরা কেবল ‘ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক দণ্ড’ দিতে পারবেন। আইন থেকে এ কথাও তুলে দিন যে ম্যাজিস্ট্রেট যদি বুঝতে পারেন যে অপরাধ নিয়মিত আদালতে ‘বিচার্য’, তাহলে তিনি দণ্ড দেবেন না। বরং অভিযোগ এজাহার হিসেবে নিতে ওসিকে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু মোবাইল কোর্ট এ পর্যন্ত এ রকম কতগুলো এজাহার সৃষ্টি করেছেন, তা জানা যায় না।

আইন থেকে আরও তুলে দেওয়া হোক যে কেবল ‘স্বীকারোক্তি’ করলেই কাউকে দণ্ড দেওয়া যাবে। সংবিধান তো বলেছে, কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকেই তার অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করা যাবে না। তাই পদ্ধতিগতভাবে সংবিধান ভঙ্গ করতে প্রশাসন ক্যাডারকে দোষীর ভাগী কেন করছে রাষ্ট্র। মোবাইল কোর্ট আইন থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ কথাটি মুছুন। আইনে লিখুন, মোবাইল কোর্ট ‘বিচার’ করতেও পারবে। তাদেরও বিচারের দরজা ২৪ ঘণ্টা খোলা। তারাও রিমান্ড দিতে পারবে।

এতক্ষণ যা বলা হলো, সেটা সাধারণভাবে সব অপরাধের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু মাদক আইনে একটা পরিবর্তন আছে। সেটা বোঝাতেই ওপরের চিত্রটি তুলে ধরা। ২০১৮ সালের মাদক আইনের ৫৭ ধারায় প্রথমবারের মতো নির্দিষ্টভাবে মোবাইল কোর্টকে ‘বিচার’ করার ক্ষমতা দেওয়া হলো। বলা হলো, ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করিয়া বিচারকার্য সম্পাদন করা যাইবে।’ কী উপায়ে বিচারকার্য চালানো হবে, তা বলা হলো না। তার মানে দাঁড়াল, ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনটির সঙ্গে ২০১৮ সালের মাদক আইনের সঙ্গে একটি সংঘাত সৃষ্টি করা হলো। একটি বলেছে তাৎক্ষণিক ‘দণ্ড’ দিতে। অন্যটি বলেছে, ‘বিচারকার্য’ করতে। অবশ্যই তাই বলে মোবাইল কোর্টের উল্লিখিত সীমাবদ্ধতা থেকে তাকে স্বাধীন করা হয়নি। পুনর্বার বলি, তার মানে মোবাইল কোর্টের সীমিত বিচারের শর্তগুলো মেনেই তাকে মাদক অপরাধীদের ‘বিচারকার্য সম্পাদন’ করতে হবে।

এক দিনে দুটি খবরের উদাহরণ দিই। ১০ নভেম্বর। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থানার ওসি নিজেই বলেছেন, তাঁরা জুয়ার বোর্ড ও গাঁজাসহ ছয়জনকে দিনে ধরেন। রাতে নেন মোবাইল কোর্টে। তাঁরা তিন মাস করে কারাদণ্ড পান। একই দিনে কক্সবাজারের চকরিয়ায় আগের রাতে গ্রেপ্তার দুই কথিত ইয়াবা ব্যবসায়ী পরদিন মোবাইল কোর্টে তিন মাসের করে কারাদণ্ড পান। দুটোতেই ২০০৯ সালের আইনের শর্তের ব্যত্যয় ঘটল। কারণ মোবাইল কোর্ট স্বীকার করছে যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ‘ঘটনাস্থলে’ ছিলেন না। এবং দণ্ডদান ‘তাৎক্ষণিক’ ছিল না।

পুলিশের পৌষ মাস। তার সামনে দুটি বিকল্প। অভিযুক্তকে সে ভয় দেখাতেই পারে, কোথায় যাবা? একই অপরাধে মোবাইল কোর্টে গেলে অল্পের ওপর দিয়ে যাবে। অন্যথায় ঠেলা সামলাও। আসামি তুমি কার? এমনকি নির্দিষ্টভাবে অনধিক দুই বছর সাজার বিধান (মোবাইল কোর্ট সর্বোচ্চ দুই বছর সাজা দিতে পারেন) থাকলেই পুলিশ অভিযুক্তকে মোবাইল কোর্টে নিতে বাধ্য নয়। তারা চাইলেই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নেবে।

পৌষ মাস কেমন দেখুন। ৫ গ্রাম মাদকে অন্তত ১, অনধিক ৫ বছর; ২৫ গ্রাম হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন। আবার অন্য মাদকে ২০০ গ্রামে অন্তত ১, অনধিক ৫ বছর; ৪০০ গ্রামে মৃত্যুদণ্ড। তো পুলিশ ৫ গ্রামের আসামিকে মোবাইল কোর্টে নিল। পুলিশের বিরুদ্ধে সুনামের ঘাটতি, তারা ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে আসামি ধরে। পুলিশ কেন, কুড়িগ্রামে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কী করেছেন? আধা বোতল মদ ও দেড় শ গ্রাম গাঁজার কারণে মধ্যরাতের ‘ঘটনাস্থলে’ ১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মাদক আইন বলছে, এক বা দুবার দণ্ডিত ব্যক্তি (অর্থদণ্ড পেলেও) আবার অপরাধ করলেই ২০ বছর সাজা বাধ্যতামূলক। এমন উদ্ভট ও অদ্ভুত সাজা দণ্ডবিধিতে থাকাই জাতির বিধি। কোনটি কী মাদক, সেটা ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া কারও ন্যায্য সাজা দেওয়া অকল্পনীয়। অথচ মোবাইল কোর্টকে ‘ঘটনাস্থলেই’ এবং তাৎক্ষণিক দণ্ড দিতে হবে। সংসদ এভাবে কারও প্রতিই সুবিচার করেনি। তাই মাদক আইনে উপযুক্ত সংশোধনী আনা ছাড়া গত্যন্তর দেখি না।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

[email protected]