আসামের নির্বাচনী প্রচারণায় এবারও হাজির বাংলাদেশ

নাগরিত্ব ইস্যু এবারের আসামের নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করবে
ছবি: সংগৃহীত


ভারতে আবার ছোটখাটো একজাতীয় নির্বাচন চলে এল। পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন হবে শিগগিরই। এর দুটি বাংলাদেশ লাগায়ো। ফলে উভয় জায়গাতেই নির্বাচনী প্রচারণায় প্রবলভাবে আছে বাংলাদেশ। আসামে বিজেপির প্রধান নেতা হিমান্ত বিশ্বশর্মা এবারের নির্বাচনকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে আসামের সভ্যতা রক্ষার সংগ্রাম’ বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে অমিত শাহ ‘বাংলাদেশের দিক থেকে পাখিও ঢুকতে না দেওয়া’র অঙ্গীকার করেছেন।

বাংলাদেশ ছাড়া যখন নির্বাচনী রসায়ন জমে না
ভারতে লোকসভার আসন ৫৪৩। যে পাঁচ রাজ্যে এবার বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে তাতে লোকসভার আসন ১১৬টি। অর্থাৎ জাতীয় রাজনীতির ২০-২৫ ভাগ এলাকাজুড়ে নির্বাচন চলবে। এ রকম গুরুত্বের কারণে নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনাও বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। এই উত্তেজনায় যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম-গন্ধ-বিদ্বেষও। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে নির্বাচনী রসায়ন জমেই না।

ঢাকায় পর্যবেক্ষকদের পুরো মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। মমতার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের ফল সেটা। কিন্তু এই ফাঁকে আসামের নির্বাচনে বাংলাদেশ নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় বাংলাভাষীদের ভোটের ময়দানে কোণঠাসা রাখাই এসবের লক্ষ্য।

জোট গড়ে সুবিধায় কংগ্রেস, প্রচারে এগিয়ে বিজেপি
আসামে লোকসভার আসন ১৪ এবং বিধানসভায় আসন ১২৬। নির্বাচন হচ্ছে কেবল নতুন বিধানসভার জন্য। সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল ২০১৬ সালে। তাতে বিজেপি ৬০ আসন পায়। এটা ছিল চমকপ্রদ এক ফল। আগের নির্বাচনের চেয়ে ৫৫টি বেশি। ১২৬ আসনের মধ্যে ৮৬টি পেয়ে সরকার গড়ে তাদের জোট। বাকি ৪০টির মধ্যে ২৬টি পায় কংগ্রেস এবং ১৪টি আঞ্চলিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)। আসামের রাজনীতির তৃতীয় শক্তি এই দল। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল। বিজেপি সুযোগ পেলেই তাঁকে বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে মাঠ গরম করে। ভোট বাক্সে কাজও হয় বেশ।

তবে আসামে ভোটের ফল অনুমান বরাবরই দুঃসাধ্য। ধর্ম, ভাষা, জাতিগত পরিচয় ইত্যাদি মিলে সেখানে ভোটের ফয়সালা হয়। প্রতিটি ভোটব্যাংক আবার নানাভাবে বিভক্ত। যেমন ৬২ ভাগ হিন্দু ভোটারের মধ্যে আছে বড়ো ও অসমিয়া ধারা। ৩৫ ভাগ মুসলমানের মধ্যে আছে বাংলাভাষী ও অসমিয়াভাষী ধারা। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা আচরণে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার মাঝেও কিছু ফারাক আছে। চা–শ্রমিকেরাও এই রাজ্যে এক ছোটখাটো ভোটব্যাংক। ১২৬ আসনের ৪৫টিতে তাঁরা আছেন বিভিন্ন সংখ্যায়। দিনে ১৬৭ রুপি মজুরি পাওয়া অতি দরিদ্র এই শ্রমিকেরা অতীতে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। এখন অবস্থা সে রকম নেই। এ রকম সাত লাখ শ্রমিককে বিজেপি এ মাসে ৩ হাজার রুপি করে নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এত দিন এই শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সায় দেয়নি তারা। এতে বাগিচার মালিকেরাও খেপল না, লেবার কলোনিও খুশি রইল!

আসাম বহুকাল কংগ্রেসের নিরাপদ নির্বাচনী জায়গা ছিল। সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একনাগাড়ে তারা এখানে ক্ষমতায় ছিল। এবার মাওলানা আজমলের দল এবং ছোট ছোট বাম দলগুলোর সঙ্গে জোট করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। আর বিজেপি বলছে, তারা আগের মতোই ‘বিদেশি খেদা’ আন্দোলনের শক্তি আসাম গণপরিষদের সঙ্গে জোট করবে। এই হিসাব যদি শেষে বহাল থাকে, তাহলে কংগ্রেসের কিছুটা লাভ। মুসলমান ভোট আর ভাগ হবে না। আবার এতে বিজেপিরও সুবিধা। কংগ্রেস যখনই মুসলমানপ্রধান এআইইউডিএফের সঙ্গে জোট করবে, তখনই বিজেপির জন্য পুরো ভোটারদের ধর্মের ভিত্তিতে দুভাগ করে ফেলা সহজ হবে। এতে কংগ্রেসের মুসলমান ভোট বাড়লেও হিন্দু ভোট কিছু কমবে।

কংগ্রেসের জন্য পরিস্থিতি খুবই জটিল। রাজ্যের ৩৫ ভাগ মুসলমান ভোট বিভক্ত হতে দেওয়া তাদের জন্য আত্মঘাতী। যেসব এলাকায় তারা শক্তিশালী সেগুলো মুসলমানপ্রধান। আবার এই ভোটারদের কাছে টেনে নিলে রাজ্যজুড়ে থাকা ৬৫ ভাগ হিন্দু ভোটের কিছু ছুটে যায়। নির্বাচনী ময়দানে তাই কংগ্রেস হিন্দু-মুসলমান কারও পক্ষেই গলা ছেড়ে কথা বলতে পারে না। তাকে দুর্বল এক ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হয়, যা বিজেপির আগ্রাসী প্রচারযুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না।

অসমিয়া তরুণেরা বিজেপির বিরুদ্ধে
কংগ্রেসের মতো বিজেপিও কিছু কৌশলগত অসুবিধায় আছে। কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট তাদের জন্য ভোটের গণিতে বড় এক চ্যালেঞ্জ। আরও বড় সংকট অনেক অসমিয়া ভোট তারা পাবে না এবার। আসামে ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে’র বাস্তবায়ন চায় না অসমিয়ারা। এ রকম অন্তত দুটি দল নির্বাচনে আলাদা জোট করছে। ফলে গতবারের চেয়ে বিজেপির ভোট কমা নিশ্চিত। তবে তাদের ছুটে যাওয়া এই ভোট আবার কংগ্রেস জোট পাচ্ছে না।

এ অবস্থা সামলাতে বিজেপি তৎপর। এত দিনকার হিন্দুত্বের পাশাপাশি এবার তারা সামনে এনেছে ‘অসমিয়া গর্ববোধ’। এর মাধ্যমে মূলত হিন্দু-অসমিয়া ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পুরো ভোট পেতে চায় তারা। ‘মিঞা’ তকমা দিয়ে বাংলাভাষী মুসলমানদের আসামের খলচরিত্র হিসেবে তুলে ধরে এআইডিইউএফ-কংগ্রেস জোটকে সমগ্র ভোটারদের কাছে ‘আসামবিরোধী’ ‘বাংলাদেশপন্থী’ হিসেবে দেখানোর কৌশল নিয়েছে বিজেপি।

নির্বাচনের বিজেপির প্রধান সেনাপতি সীমান্ত বিশ্বশর্মা ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছেন: ‘আমরা মিঞাদের ভোট চাই না।’ তাঁর মতে ‘মিঞা’ মুসলমানরা ‘বাংলাদেশ থেকে আসামে গিয়েছে’। এই বিশ্বশর্মাই গত বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে ‘বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের নেত্রী’ বলেছিলেন।

মাঠে নেমেছে অসমিয়াদের স্বতন্ত্র জোট
কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে আসামে এবার তৃতীয় জোটটি গড়েছে দুটি আঞ্চলিক দল। একটির নেতৃত্বে কৃষকনেতা অখিল গগৈ। দলের নাম ‘রাইজর দল’। অসমিয়া ভাষায় রাইজর মানে জনতা। অখিল গগৈ এক বছর ধরে কারাগারে। বারবার তাঁর জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। দিব্রুগড়, তিনসুকিয়া, দেমাজি, মাজুলি প্রভৃতি অসমিয়াপ্রধান জেলায় এই দলের প্রভাব আছে। এককালে এসব জেলায় উলফার খুব প্রভাব ছিল। সেই পরম্পরারই ফসল এই জোট।

রাইজর দলের সঙ্গে আছে আসাম জাতীয় পরিষদ। এর নেতৃত্বে লুরিন জয়তী গগৈ। দুটি দলই আসামে নাগরিকত্ব নেই এমন অ-মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরোধী। বিজেপি ওই রকম একটা প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। উল্লেখ্য, ভারতে মুসলমানরা নাগরিকত্ব যাচাইয়ের উদ্যোগ এবং নাগরিক আইনের নতুন সংশোধনীর বিরোধিতা করছিল যে অবস্থান থেকে, রাইজর দল ও জাতীয় পরিষদের বিরোধিতার সঙ্গে তার মিল নেই। এই অসমিয়ারা মনে করে, বিজেপি নতুন নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে আসলে আসামে নাগরিকত্ব যাচাইকালে বাদ পড়া বাংলাভাষী হিন্দুদের নতুন করে আসামে বসতি দিতে চায়। আপার আসামে অসমিয়াদের এই জোট সব আসনে কিছু ভোট কাটবে। তাতে বিজেপি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কংগ্রেসের লাভ হবে না।

প্রধান ইস্যু নাগরিকত্ব আইন
আসাম ভারতে তুলনামূলকভাবে অনুন্নত এবং প্রান্তিক রাজ্য। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে উন্নয়নের বদলে ধর্ম ও জাতিগত বিভেদ-সংঘাতই প্রধান ইস্যু হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন এই রাজ্যে বিতর্কের প্রধান বিষয় তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান’ ইস্যু। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই ইস্যুতে আসাম উত্তাল। একসময় বলা হতো প্রায় এক কোটি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ আছে আসামে। তার খোঁজ নিতে ‘এনআরসি’ (নাগরিকদের শনাক্ত করা) হয়। ওই দাবির সত্যতা মিলেছে সামান্যই। মাত্র ১৯ লাখ নাগরিকের কাছে নাগরিকত্বের কাগজপত্রের অভাব দেখা গেছে। সাড়ে তিন কোটি মানুষের রাজ্যে যা মাত্র ৫ ভাগের মতো।

এনআরসির পর বিজেপি অবৈধ শনাক্ত হওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিলে আবার উত্তপ্ত হয় আসাম। শুরু হয় ‘নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন বিরোধী আন্দোলন’। এবার নির্বাচনে প্রধান ইস্যু মূলত এটাই। অসমিয়ারা নতুন করে আসামে কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিপক্ষে। বিজেপি এনআরসিতে বাদ পড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে চাইছে। এই দিতে চাওয়া, এটা ধরে নিয়ে যে ওই ‘অবৈধ’রা বাংলাদেশ থেকে গেছে। অথচ কথিত অবৈধরা বলছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলেও যুগের পর যুগ তারা আসামেই আছে। বিজেপির নাগরিকত্বের রাজনীতির বিপরীতে কংগ্রেস চাইছে প্রচারে বেকারি ও দ্রব্যমূল্য প্রধান হয়ে উঠুক। নির্বাচনে তাদের স্লোগান, ‘আসাম বাঁচাও’।

তবে নির্বাচন এসব স্লোগান ও কর্মসূচিতে আটকে নেই। শুরু হয়েছে অর্থের খেলা এবং মিথ্যাচারের মহাযুদ্ধ। প্রদেশটিতে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠন আছে কেবল বিজেপির মূল সংগঠন আরএসএস-এর। তারা ভোট এলেই মুসলমান ভীতি ছড়াতে সর্বগ্রাসী এক প্রচারাভিযানে নামে। ভোটারদের কাছে নানা উসকানিমূলক প্রশ্ন হাজির করা হয়। যেমন, ‘আপনি কী চান আসামে আবার মোগলদের রাজত্ব কায়েম হোক?’ কিংবা ‘আসামে বাংলাদেশিদের শাসন কায়েম হোক এটা চান?’ এ রকম প্রশ্ন তুলে কিছু এলাকায় বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে এবং কিছু এলাকায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়। এতে ভোটে জাতিবাদী ও ধর্মবাদী মেরুকরণ ঘটতে থাকে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা জিতে যায়।

এ রকম বিষাক্ত আবহাওয়ার কারণেই অতীতে বাংলাদেশ-আসাম সম্পর্ক প্রত্যাশিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারেনি। যদিও ঢাকার সরকার আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতকে যোগাযোগ সুবিধা দিয়েছে উদারভাবে।

এককালে বাংলা ও আসাম এক দেশ ছিল। ব্রহ্মপুত্রের একই উপত্যকায় তাদের চিরস্থায়ী অবস্থান। অথচ সীমান্ত লাগোয়া এই দুই জনপদের মাঝে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। সুসম্পর্ক তো দূরের বিষয়, আসামে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরার দাবি তোলা হয় এবং বাস্তবেও সেটা করা হয়েছে। পাশাপাশি এখন ১৯ লাখ স্থানীয়কে ‘রাষ্ট্রবিহীন’ করে রাখা হয়েছে পরোক্ষে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে। আসন্ন নির্বাচনে এই মানুষদের বারবার বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে দেখানোর কমতি থাকবে না। যেহেতু একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গেও নির্বাচন হচ্ছে, সে কারণে এবার হয়তো সীমান্তের দুই দিকেই বাংলাদেশকে বিরক্তিকর নানা মিথ্যাচার সইতে হবে।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক