আসিয়ান, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সংকট

গত ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) একটি ডিজিটাল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমি একজন বক্তা ছিলাম। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: রেসপন্স অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন প্রসেস’, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সাড়া এবং প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া’। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল, ‘আসিয়ান, মিয়ানমার অ্যান্ড দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস’ (আসিয়ান, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সংকট)। অর্থাৎ, রোহিঙ্গা সংকটে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অবস্থান ও মিয়ানমারের বিষয়।

বিআইআইএসএস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থিঙ্কট্যাংক হিসেবে অধিক পরিচিত। স্বাভাবিকভাবে এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার ডেস্কের পরিচালক মহোদয়ও উপস্থিত ছিলেন এবং প্রধান অতিথি হিসেবে সমাপনী বক্তব্য দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য দেন। উপসংহারে প্রায় অভিন্ন মত হিসেবে যা উঠে আসে তা হলো, বাংলাদেশকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে আরও সক্রিয় হতে হবে। এ জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও প্রত্যাবর্তনের পথ খোলা রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

ওই ওয়েবিনারে আমার উপবিষয় ও আসিয়ান জোটের মনোভাবের ওপর কিছু আলোচনার জন্য আজকের এ লেখা। আমার বিষয় ছিল আসিয়ান, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা।

প্রথমে আসিয়ান নিয়ে বলতে চাই। আসিয়ান গোষ্ঠীর ১০টি দেশের প্রতিটির চরিত্র ভিন্ন, বাসিন্দাদের ধর্ম পরিচয় ভিন্ন এবং প্রায় প্রতিটিতেই গণতন্ত্রের অভাব। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য রয়েছে। লাওসে চলছে একদলীয় শাসন। কম্বোডিয়ায় ৩৫ বছর ধরে একই ব্যক্তি এবং দলের শাসন চলছে। শেষোক্ত দুটি দেশেই পার্লামেন্টে সরকারি দলের একক উপস্থিতি রয়েছে এবং রাষ্ট্র দুটি চীনের প্রভাবে প্রভাবিত। মিয়ানমারের বিষয়ে আমরা অল্পবিস্তর অবগত আছি। সেখানে বেশির ভাগ সময়ই সেনাশাসন ছিল। পাঁচ বছর গণতন্ত্রের নামে ছিল দ্বিমুখী সরকার। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটির গদিতে আবার সামরিক জান্তা চেপে বসেছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে কথিত নির্বাচিত বেসামরিক সরকার, যারা সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছিল। এই ১০টি দেশের মধ্যে ৩টি মুসলিমপ্রধান—মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনেই। ব্রুনেইয়ে রাজতন্ত্র। মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। তথাপি আসিয়ান গোষ্ঠীর কার্যপ্রণালিতে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিষয়টিই মুখ্য।

আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে তিনটিতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রয়েছে। থাইল্যান্ড মিয়ানমারের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী দেশ। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে এবং এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। এই উদ্বাস্তুরা থাইল্যান্ডে গিয়েছেন এবং এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা মালয়েশিয়ার সীমান্তঘেঁষা থাইল্যান্ডের সীমান্তে রয়েছেন। তাঁরা সেখান থেকে মালয়েশিয়াতে যাওয়ার আশায় রয়েছেন।

স্মরণযোগ্য যে ওই অঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মূলত মিয়ানমারের সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত পশ্চিম সীমান্তবর্তী আরাকানে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে উৎখাত হওয়ার আগে একসময় উত্তর আরাকানের মায়্যু অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। উৎখাত হওয়ার পর থেকে মালয়েশিয়াতে দুই লাখের ওপরে এবং ইন্দোনেশিয়াতে ২০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গার উপস্থিতি রয়েছে।

এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের পছন্দের দেশ মালয়েশিয়া, যদিও মালয়েশিয়াতে স্বল্পসংখ্যক সরকারি ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে শিবির রয়েছে। বর্তমানে মালয়েশিয়া সরকার বাকি সবাইকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনকি দেশটি বেআইনিভাবে আসা রোহিঙ্গাদের শাস্তির বিধানও রেখেছে। তথাপি এদের বেশির ভাগ শহরের বাইরে অল্প বেতনে শ্রমিক হিসেবে রাবার ও পামবাগানে কাজ করে। তা ছাড়া রোহিঙ্গা মেয়েদের স্থানীয়দের সঙ্গে বিয়ের খবরও পাওয়া যায়। প্রথম দিকে মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুক্ত হয়নি। ইন্দোনেশিয়াতেও প্রায় একই অবস্থায় রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আগের কয়েকটি আসিয়ান বৈঠকে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার ছিল না, এখনো নেই।

তবে ‘আসিয়ান’ গোষ্ঠী হিসেবে একেবারে নির্লিপ্ত ছিল, তেমনটিও নয়। এর আগে ২০১৮ সালে আসিয়ান সেক্রেটারি জেনারেল রাখাইন পরিস্থিতি ও উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। ২০১৯ সালে পুনরায় আসিয়ান সরেজমিনে রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধান এবং নিরসনের উপায় খুঁজতে বাংলাদেশের ক্যাম্পে অবস্থান করা ১১ লাখ রোহিঙ্গার ওপর প্রতিবেদন দিয়েছিল। এরই নিরিখে বিগত দুই আসিয়ান শীর্ষ বৈঠকের প্রতিবেদনে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করেও সংকট নিরসনের কথা বলা হয়েছিল। তবে তেমন কিছুই এগোয়নি।

তবে গত ২৪ এপ্রিল জাকার্তায় আসিয়ান চেয়ারম্যান ব্রুনেইয়ের সুলতান বলখিয়ানের সভাপতিত্বে যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে আসিয়ানকে আগের তুলনায় মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কিছুটা পরিবর্তিত মনে হয়েছে। কারণ, ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর এই আঞ্চলিক জোট মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল বা রয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে প্রাণহানি এবং দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আসিয়ান উদ্বিগ্ন ছিল।

গদি দখলের বিষয়টি থেকে দৃষ্টি এড়াতে জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক শোকেস হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নিয়ে এগোতে চাইবে। এ প্রক্রিয়ায় তারা কতখানি আন্তরিক থাকবে, তা হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সূত্রপাত করলেই পরিষ্কার হতে পারে

যা-ই হোক, এবারের আসিয়ান শীর্ষ বৈঠক বেশ গুরুত্ব বহন করে। কারণ, সেখানে মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সশরীর উপস্থিতি ছিল। মিন হ্লাইংয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর নিষেধাজ্ঞা আছে। তারপরও ‘আসিয়ান’ বৈঠকে হ্লাইংয়ের যোগদান গুরুত্ববহ ছিল।

কারণ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আসিয়ানের মধ্যস্থতাসংক্রান্ত যে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল, সেখানে রাখাইন রাজ্যের নাম না নেওয়া হলেও উদ্বাস্তু হিসেবে যারা বাংলাদেশে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে, তাদের সমস্যা (রোহিঙ্গা সমস্যা) সমাধানে আরও মনোযোগী হওয়ার আলোচনা হয়েছে।

ওই সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ‘যাচাই–বাছাইয়ের’ পর প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। এই প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, এ বিষয়ে প্রয়োজনে আসিয়ান সচিবালয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।

এমন নয় যে আসিয়ান এই প্রথম বিষয়টি তুলে ধরেছে। অতীত বৈঠকগুলোতেও একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো, সামরিক জান্তার উপস্থিতিতে ও সম্মতিতে এই কথা যুক্ত করা হয়েছে।

সেনা শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে মিন হ্লাইংয়ের উপস্থিতি এবারের আসিয়ানের শীর্ষ বৈঠককে গুরুত্ববহ করেছে।

আসিয়ানের এই অভিপ্রায়কে সামরিক জান্তা কতটা প্রাধান্য দেবে, তা নিশ্চিত নয়। আসিয়ানের মূল লক্ষ্য মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট অবসানে সরকার ও বিরোধীদের আলোচনায় সহযোগিতা করা। কিন্তু আসিয়ানকে সেই ভূমিকা পালনে জান্তা সরকার কতটুকু সহযোগিতা করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

আমার মনে হয়, গদি দখলের বিষয়টি থেকে দৃষ্টি এড়াতে জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক শোকেস হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নিয়ে এগোতে চাইবে। এ প্রক্রিয়ায় তারা কতখানি আন্তরিক থাকবে, তা হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সূত্রপাত করলেই পরিষ্কার হতে পারে।

জান্তা সরকার আদৌ যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে তা হবে সামরিক জান্তার বহির্বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ এবং সময়ক্ষেপণের প্রয়াস। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, রাখাইনে সামরিক জান্তা যেকোনো আলোচনায় আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএমপি) এবং আরাকান আর্মিকে (এএ) সংযুক্ত করতে চাইবে।

এনপির আর্মড উইং হলো ‘এএ’, কাজেই এরাই রাখাইনের স্থানীয় অধিবাসী বৌদ্ধ ও অন্য উপজাতিদের (রোহিঙ্গা বাদে) প্রতিনিধিত্বের দাবিদার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের আলোচনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট এত সহজে সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তথাপি বাংলাদেশের সামনে শুধু জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]