আসুন, আমরা বরং চুপ করেই থাকি

.
.

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে, মার্কিন প্রবাসী বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায়কে বইমেলার প্রবেশপথে হত্যা করার রাতে প্রচণ্ড আকুতি নিয়ে লিখেছিলাম, ‘আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন।’ (প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। মানুষ প্রথম কিছুদিন রাস্তায় নেমেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছিল। খুব আশান্বিত হয়েছিলাম ‘নাস্তিক’ নামের সঙ্গে যে ট্যাবু যোগ করা আছে, সেই অচলায়তনে বুঝি ফাটল ধরেছে। মানুষ বুঝি দুঃখ পেয়েছে মানুষের মৃত্যুতে।
অভিজিৎ রায় নিজের কাজে বিখ্যাত ছিলেন, বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা পিতা অধ্যাপক অজয় রায়ের পুত্র, ছিলেন মার্কিন নাগরিক। কিছুদিন বেশ তদন্ত-তদন্ত রব পড়ে গেল। এফবিআই উড়ে এল। কিন্তু ছয়IJ মাস হতে চলল, তদন্তের কোনো ফল আমরা পাইনি। শুধু অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজ্ঞান-লেখক বন্যা আহমেদ, যিনি নিজেও সেই ভয়াল আক্রমণের শিকার, মাথায় কোপ, কাটা আঙুল আর প্রিয় মানুষের রক্তাক্ত দেহের স্মৃতি নিয়ে রয়টার্স-বিবিসি-ভলতেয়ার লেকচার—সব জায়গায় ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন অন্ধ অসির বিরুদ্ধে মসির যৌক্তিক লড়াইয়ের কথা। আশা জানাচ্ছেন, একদিন যুক্তির জয় হবে। অভিজিৎ রায়ের পিতা অধ্যাপক অজয় রায় বড় আশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রীসম সম্বোধন করে পুত্রহত্যার বিচার চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে ফোনে সমবেদনা জানালেও সে খবর গণমাধ্যমে আসেনি। কেন আসেনি, সে উত্তরও আমরা পেয়েছি রয়টার্সকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর পুত্র এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতই নাজুক যে প্রকাশ্যে কিছু বলা তাঁর জন্য কঠিন।
অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে বেশ সরব ছিলেন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মাথায়, ৩০ মার্চ, নিজের বাসার সামনেই তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। যে তিনজন হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে, তাদের মধ্যে দুজনকে এলাকার মানুষ, মূলত দুজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন রক্তমাখা চাপাতিসহ ঘটনাস্থল থেকে। এরা দুজন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ এবং মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। অপরজন আবু তাহের পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের স্বীকারোক্তি প্রকাশিত হয়েছিল সব গণমাধ্যমে। তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ীই ‘বড় ভাই’ নির্দেশনাদানকারী ‘মাসুম ভাই’য়ের নামেও মামলা করা হয়েছিল। আশা ছিল, ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি রক্তাক্ত চাপাতি হাতে যেহেতু ধরা গেছে জিকরুল্লাহ আর আরিফুল ইসলামকে এবং যেহেতু তারা হত্যার দায় স্বীকার করেছে ‘ইমানি’ দায়িত্ব পালনের কথা বলে, এবার নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। পাঁচ মাস হলো। তদন্ত এখন কোন পর্যায়ে আছে, ‘নির্দেশনাদানকারী হুজুর’ আসলে কে, এসব খুনির নেটওয়ার্ক কী—কিছুই আমরা জানি না।
ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার ১ মাস ১২ দিন পরে, ১২ মে, একইভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হলো বিজ্ঞান-লেখক ও মুক্তমনার ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে, সিলেট শহরের সুবিদবাজারের নূরানি আবাসিক এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে। অনন্ত বিজয় দাশের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন, তিন সপ্তাহ পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। সিআইডি ইদ্রিস আলী নামের এক স্থানীয় ফটোসাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছিল, তারপর কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না, দেশবাসী জানে না।
আর ৭ আগস্ট, অনন্ত বিজয় হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ে, দিনদুপুরে ঘরে ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লিখতেন তিনি ইস্টিশন ব্লগে, নিলয় নীল নামে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় ছিলেন। বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি হুমকি পেয়ে আসছিলেন। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিয়ে ঘরে ফেরার পথে কয়েকজন তাঁকে অনুসরণ করছে বুঝতে পারেন। তিনি নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে আড়াই মাস আগে থানায় থানায় ঘুরেছেন জিডি করার জন্য, কিন্তু পুলিশ জিডি নেয়নি বরং দেশ ছাড়তে পরামর্শ দিয়েছে—এই কথা তিনি ফেসবুকে লিখে জানিয়েছেন ১৫ মে।
হত্যাকাণ্ডের চার ঘণ্টা পরে আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা, আনসার আল ইসলাম নামে গণমাধ্যমগুলোতে ই-মেইল পাঠিয়ে দায় স্বীকার করেছে। এই একই গ্রুপ অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছিল হত্যাকাণ্ডের দুই মাস পরে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটিজ নামের একটি ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এই বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের পরে দায় স্বীকার করে বার্তা এসেছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ৮ নামের এক টুইটার থেকে, সেখানেই বলা ছিল আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার কাজ এটি। বার্তাটি ছিল, আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আল-কায়েদা উপমহাদেশ শাখার ভাইয়েরা আরও এক ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে। ওয়াশিকুরের হত্যাকারীরা স্বীকার করেছে, তারা ব্লগ কী জানে না, ‘বড় ভাই’য়ের নির্দেশে ইসলামের দুশমনদের হত্যা করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। বোঝা যায়, আল-কায়েদা পরিচয়টি ওজনদার, এই নাম থাকলে বিচারকাজ আগায় না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘসহ অনেকেই নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে বাংলাদেশ সরকারকে এসব হত্যাকাণ্ড শক্ত হাতে দমনের দাবি জানিয়েছে। এসব দাবি কিছুদিন চলবে। বেশ কিছু মানববন্ধন, কলাম লেখা এবং টক শো হবে। তারপর আমরা ভুলে যাব সব, পরের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে পর্যন্ত। অবস্থা এমন হয়েছে যে বাংলাদেশে এখন ‘ব্লগার’ শব্দকে সমার্থক করা হয়েছে ‘নাস্তিকতা’র সঙ্গে আর কাউকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিতে পারলে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে যেমন কাউকে ‘কমিউনিস্ট’ কিংবা ‘ভারতের চর’ বা ‘হিন্দু’ আখ্যা দিতে পারলে তার ওপর যেকোনো অত্যাচার জায়েজ ছিল।
আমরা ভুলে যাই, ব্লগারদের সঙ্গে নাস্তিকতার ট্যাগটি দেওয়া হয়েছিল শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য, যার প্রথম বলি হয়েছিলেন রাজীব হায়দার। রাজীবকে নাস্তিক-ব্লগার প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ম্রিয়মাণ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমরা এও ভুলে যাই, নাস্তিক-ব্লগার নাম দিয়ে যে আন্দোলনকে ম্রিয়মাণ করার চেষ্টা হয়েছে, সেই আন্দোলনের মূলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। ধারাবাহিক ব্লগার হত্যার মুখ্য অন্তর্নিহিত রাজনীতি নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করা, বিচারের দাবিতে সোচ্চার যাঁরা তাঁদের এক এক করে হত্যা করা এবং সমান্তরালে অবশ্যই রয়েছে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের কাউকে বাঁচতে না দেওয়া।
ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচারে সরকারের অপারগতা, নীরবতা অ্যাবসার্ড নাটকের মতো মনে হয়। রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড আজ এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেছে যে মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপকের পুত্রশোকে প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনে সান্ত্বনা দেওয়ার কথাটিও গণমাধ্যমে চেপে যেতে হয়। বড় আজব সময় পার করছি আমরা। আনসারুল্লাহ বাহিনী তাদের ঘোষিত লক্ষ্য প্রতি মাসে একজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে আর সরকার, সব রাজনৈতিক দল এবং তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তি সবাই চুপ করে দেখে যাচ্ছে। মিডিয়ার তত্ত্ব বলে, বীভৎস দৃশ্য দেখতে দেখতে মানুষের গা-সওয়া হয়ে যায়, স্বাভাবিক মনে হয়। নানাভাবে নারী নির্যাতন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত নির্যাতন, পোশাকশ্রমিকদের পুড়ে মরা, পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মরা, পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বীভৎস কায়দায় শিশু হত্যা—এসবই আমাদের সহ্যসীমার আওতায় এসে গেছে।
মাথায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দেওয়া মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আমাদের অনেকের জীবনই তো চলে যাচ্ছে। সমস্যা আসলে তেমন কিছু ছিলও না। শুধু এক পরাবাস্তব কাহিনির মতো মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য অসার করে ফেলে। যখন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছিল কিংবা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে হুমকি দেওয়া হয়েছিল অথবা দ্বিতীয়বার কাঁধে আঘাত করা হয়েছিল আসিফ মহিউদ্দিনকে, তখন অন্য অনেকের সঙ্গে অভিজিৎ রায়ও লিখেছেন, নানা মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের
চেষ্টা করেছেন। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হলে লিখেছেন ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ। ওয়াশিকুরকে হত্যা
করা হলে লিখেছেন অনন্ত বিজয়। অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব ছিলেন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফেরার পথে তিনি বুঝতে পেরেছেন আততায়ীর অনুসরণ। ৭ আগস্ট তাঁকেও খুন করা হলো। ঘাতকের অভয়ারণ্যে ফের যদি ভিন্নমতের কোনো মানুষকে ঘোষণামাফিক মেরে ফেলা হয় আগামী মাসে, শোক কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশে যাওয়ার, নিদেনপক্ষে ফেসবুকে ঘটনার নিন্দা করার মতো মানুষও তো আর থাকছে না বিশেষ। তবু চলুন, আমরা বরং সব দেখেশুনে চুপ করেই থাকি।
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।