পত্রিকা খুলতেই প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ছাপানো বিভীষিকা, কালো অক্ষরে রচিত অবমাননার খবর। ঈদের তিন দিনে সারা দেশে ধর্ষণ ৫, ধর্ষণজনিত খুন ২। উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণের সংখ্যা। নিগ্রহের মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। গণমাধ্যমে যতটুকু জানি, তা-ও শুধু ডুবোপাহাড়ের ভাসমান চূড়াটুকু। ঘটনার পৌনঃপুনিকতা প্রমাণ করে, ধর্ষণ অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ বলে গণ্য হয়ে উঠেছে।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয় এই বীভৎস অপরাধের। একটা ভাবনা শুধু ঘুরেফিরে আসে, কবে শেষ হবে এই বিভীষিকাময় রাত্রি, চরমতম অবমাননার প্রহর? কবে ধ্বনিত হবে প্রতিবাদের বলিষ্ঠ স্বর, কবে গড়ে উঠবে ব্যূহ?
চলন্ত বাসে ধর্ষিত হয়েছে রূপা, শুধু তা-ই নয়, ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খেয়েছে মধ্যরাতের মামদো ভূতের দল। ১৩ বছর বয়সের পর মায়েরা যে ভূতের ভয় দেখিয়েছে, বাড়িতে সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে, হাঁটুর ঝুল ফ্রকে বাহুল্য অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। চলাফেরা, মেলামেশায় হাজারটা নিষেধাজ্ঞা। ভাবতাম, এসব মেনে চললে ভূতেরা ঘাড়ে চাপবে না।
তারও অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, না, পুরুষরূপী এই ভূতগুলোর কোনো বাছবিচার নেই। বয়স হোক না ৫ মাস, ৫ বছর, ৫০ কি তারও অধিক—শুধু সে ‘মেয়েমানুষ’ হলেই হলো। দিন-রাত বলে কথা নেই, সকাল-দুপুর-বিকেল, সন্ধ্যা, রাত—যেকোনো সময়, যেকোনো ঘরের, যেকোনো বয়সের মেয়ে নরপিশাচদের বিকৃত লালসার শিকার হতে পারে। স্থান, কাল, পাত্র, সম্পর্কনির্বিশেষে ওদের শুধু নারীদেহ, নিছক একতাল মাংসপিণ্ড চাই।
উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত—কোনো শ্রেণিই নিরাপদ নয়। ধর্ষণের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ নিয়ে আমাদের প্রচেষ্টার শেষ নেই। তারপরও প্রতিদিন ঘটছে নিত্যনতুন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এ ধর্ষণ–সংস্কৃতির অবসান চাইলে সমাজে যেসব ব্যবস্থা বা আচরণ ধর্ষণকে বৈধ করে এবং ধর্ষক তৈরি করে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
ভাবতেই শিউরে ওঠে গা! এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে রূপার মতো আমাকে মফস্বল শহর থেকে ঢাকা যেতে হতো চাকরির সন্ধানে। মা-বাবার কত আশঙ্কা! শিক্ষা অফিসার হিসেবেও যখন কাজ করেছি, প্রতিদিন বাসে চেপে যেতে হতো প্রত্যন্ত উপজেলা সদরে। যেখান থেকে সন্ধ্যার পর একটিমাত্র বাস। ঝড়-বৃষ্টির রাতে কখনো বাসটিতে একমাত্র নারী যাত্রী আমি।
না, তখনো সারদার মাঠে রপ্ত করা আত্মরক্ষার নিরস্ত্র কৌশলগুলো আমার সঙ্গী ছিল না। ছিল শুধু জাগ্রত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, যা হয়তো আমাকে সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু রক্ষার জন্য নয়। হয়তো একই ঘটনা আমার সঙ্গেও হতে পারত। ভাবতেই শিউরে ওঠে গা!
ধর্ষণ নিয়ে আমি কিছু বলব না। কারণ, এর আগে অনেক লজ্জা, ক্ষোভ, পরিতাপ, অনুযোগ প্রকাশ করেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে কিছুটা অনুতপ্ত হয়েছি। চেষ্টা করেছি এ-সংক্রান্ত দায়ের হওয়া মামলাগুলো সর্বাধিক সতর্কতার সঙ্গে দেখার।
কিন্তু না, উপর্যুপরি কয়েকটা ঘটনায় মনে হলো, না, চোরাকে ধর্মের কাহিনি না শুনিয়ে সময় এসেছে প্রতিবাদ করার, গৃহস্থকে সজাগ রাখার। আমরা এমন এক সমাজের বাসিন্দা, যেখানে মানবিক শক্তি নয় ‘বাহুবলী’দের পেশিশক্তির জয়জয়কার সর্বত্র। আমি শুধু বলতে চাই, এই সব বাহুবলীর হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রথম প্রয়োজন আত্মরক্ষার নিরস্ত্র কৌশলগুলো অনুশীলন করা।
যদিও আমাদের মতো বাংলাদেশের আবহাওয়ায় দুধে-ভাতে মানুষ সুশীল শ্রেণির বোনদের পক্ষে এটা দুরূহ ব্যাপার, তবু কেউ আপনাকে বাঁচাতে আসার আগে নিজে অন্তত প্রথম প্রতিরোধটা গড়ে তুলুন।
২০১২ সাল থেকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি টোল ফ্রি হেল্পলাইন কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো সম্পর্কে জানাও একধরনের সেল্ফ ডিফেন্স। শিশুর আইনগত সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার শিশু সুরক্ষাবিষয়ক হেল্পলাইন-১০৯৮ চালু করে গত বছরের ২৭ অক্টোবর।
নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সেবা দিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা অধিদপ্তর ‘১০৯২১’ সেন্টার বা হেল্পলাইন চালু করে ২০১২ সালের ১৯ জুন। বর্তমানে এটি পরিবর্তিত হয়ে ‘১০৯’ করা হয়েছে। এই হেল্পলাইনটিতে ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৪০০ কল আসে।
তাৎক্ষণিক পুলিশি সেবা পেতে ‘BD POLICE HELP LINE’ চালু আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সব থানার অফিসার ইনচার্জের তথ্যসংবলিত অ্যাপস চালু আছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার ভিকটিমদের জন্য রয়েছে টোল ফ্রি হেল্পলাইন ‘৯৯৯’। আছে বাংলাদেশ পুলিশের তত্ত্বাবধানে আটটি বিভাগীয় শহরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার। আপনার নিকটস্থ পুলিশি সেবাসমূহের ফোন নম্বরগুলো সংগ্রহে রাখুন। বিপদে একাধিক নম্বরে প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন।
কোনো সমস্যার প্রতিকার বা উত্তরণের পূর্বশর্ত যেহেতু প্রতিবাদ, আর প্রতিবাদের পূর্বশর্ত যখন সমস্যাটির বিষয়ে সচেতনতা, প্রতিরোধ গড়ে তোলার এতগুলো অস্ত্র আমাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও রয়েছে সচেতনতার অভাব। সচেতনতা তৈরি করা দরকার পরিবারে, তৈরি করা দরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ধর্ষণের যথাযথ বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মধ্যকার ধর্ষকমানসটিকে চিহ্নিত করে তার অবসান ঘটানো জরুরি।
রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করি, অভিসম্পাত দিই, ভর্ৎসনা করি আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি বলে। করার আছে অনেক কিছু, কিন্তু সীমাবদ্ধতাও অনেক। দিল্লিতে নির্ভয়ার ঘটনাটা মনে আছে? উন্নত দেশগুলোতেও অজস্র ব্যর্থতার উদাহরণ আছে। সমাজের প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করা হয়, আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাটাও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।
অনেকে ধর্ষণসংক্রান্ত নতুন আইন প্রচলনের কথা বলেছেন। প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। এ-সংক্রান্ত আমাদের দেশের প্রচলিত আইনগুলো যথেষ্ট কার্যকর এবং এ আইনেও ধর্ষণের ফলে মৃত্যুর সর্বোচ্চ শাস্তিও কিন্তু মৃত্যুদণ্ড। আইন রয়েছে, প্রয়োগকারী সংস্থাও রয়েছে। এখন দরকার শুধু দ্রুততম সময়ে সর্বোত্তম প্রয়োগ নিশ্চিত করা। আইনের অধিকার সচেতনতাটাও একধরনের নাগরিক কর্তব্য।
একটি একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, আমরা স্তব্ধ হই, আমরা শোকাহত হই, লজ্জিত হই, ঘৃণায়, প্রতিবাদে ফেটে পড়ি। মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন হয়। হইচই-ডামাডোল থেমে গেলে চুপ হয়ে যাই আমরা। আবার ভাত খাই, সাজগোজ করি, ঘুরতে যাই, ফেসবুকে ছবি দিই। রীতিমতো ভুলে যাই পূজা, তনু, রূপাদের। আমরা নিশ্চিন্তে থাকি যতক্ষণ না আমাদের নিজেদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছায়।
আসুন, এই ভূত তাড়ানোর মন্ত্র শিখি। ঘরে ঘরে প্রতিবাদের সুরে সচেতনতা গড়ি। আসুন, আইনকে জানি, আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকারকে নিশ্চিত করি। বন্ধ করি ধর্ষণের এই অপসংস্কৃতিকে।
সোনালী সেন: জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ।