আহা, আমাদের ব্যাধিসমূহ

প্রতিদিনের মতো দিনের কাজ শেষে গাঢ় সন্ধ্যায় পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ফিরছিলাম। তখন শীতকাল ছিল। মহল্লা এ সময় ভিড় এবং কোলাহলহীন থাকার কথা। সেদিন তা ছিল না। বাসার একটু পাশেই রকমারি পণ্যের দোকান বিসমিল্লাহ স্টোর। তেমাথার ওই দোকানের সামনে নারী-পুরুষ-শিশুদের ভিড়। ঘটনা কী? আমাকে দেখে টগবগে তরুণ রনি এগিয়ে এল। সঙ্গে সুঠাম শরীরের এক যুবক। যুবকের চোখে জল; বাঁ হাত দিয়ে নিজের বাঁ কান চেপে ধরা। হাত ও কানের মাঝখানে একটি পুরোনো গামছা। একটু পরপর গামছা কানে চেপে ধরছে আবার চোখের সামনে এনে দেখছে।

রনি জানাল বিস্তারিত। সজল ওই চোখের যুবকের নাম ইমদাদ। জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা রকমের কাজ করে সে। ইদানীং সে ভ্রাম্যমাণ ঠেলাগাড়িতে করে চিতই পিঠা বিক্রি করছে। শীতের সময়টাতে সরষেবাটা, ধনেপাতাবাটার চাটসহ চিতই পিঠার দারুণ কদর। পশ্চিম পান্থপথের নামী এক হাসপাতালের সামনের সড়ক ফুটপাতে সেদিনও ইমদাদ পিঠা বেচছিল। হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী আগে কদিন শাসিয়েছে। আর শাসানি নয়, আচমকা দুজন চড়াও হয়েছে ইমদাদের ওপর। ভ্রাম্যমাণ দোকানটি লন্ডভন্ড করে বেধড়ক পিটিয়েছে। কারও একজনের প্রবল চড় ইমদাদের বাঁ কানের ওপর পড়েছে, ইমদাদ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, উঠে দেখে তার বাঁ কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কানে প্রচণ্ড ব্যথা এবং শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শ্রুতিতে। দরিদ্র মানুষেরা দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সংগত কারণেই এবং অনেকটা সময় হতবিহ্বল থাকে। ইমদাদ ও তাকে ঘিরে থাকা সেই সন্ধ্যার মানুষজন যখন শাপশাপান্ত করে চলছিল সেই দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে, আমি তখন দ্বিধাহীনভাবে ফোন করছিলাম বারডেম হাসপাতালের নাক–কান–গলা বিশেষজ্ঞ বাঁধনকে। বয়সে তরুণ কিন্তু দক্ষতা ও দায়বদ্ধতায় প্রাজ্ঞ চিকিৎসক বাঁধন সেদিন চেম্বারের সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও ইমদাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন। ইমদাদের কাছেই পরে জেনেছি, নিজ পকেট থেকে টাকা ব্যয় করে প্রয়োজনীয় ওষুধও কিনে দিয়েছিলেন চিকিৎসক বাঁধন।

এ রকম আরও অনেকেই আছেন। দক্ষ শল্যবিদ সমীরণ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ মানস কুমার গোস্বামী, লিভার বিশেষজ্ঞ আজমসহ কতজনের কাছে যে নিজের এবং অন্যের প্রয়োজনে কৃতজ্ঞ হয়ে আছি। এই কৃতজ্ঞতা শুধু আমার একার সুচিকিৎসার জন্য নয়। আমার পাঠানো চিকিৎসাপ্রার্থী অনেককেই তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, দিকনির্দেশনা ও করণীয় বিধান করেছেন বিনা পারিশ্রমিকে। বিষয়টি এমন নয় যে চিকিৎসাপ্রার্থী সবাই ইমদাদের মতো দরিদ্র কিংবা আর্থিক দিক থেকে উপায়হীন। এমনও হয়েছে, চেম্বার ঘুরে আসা রোগীদের অনেকেই সলাজ অনুযোগ করে জানিয়েছেন আমাকে, ‘ভাই, ডাক্তার সাহেব তো ভিজিট নিলেন না।’ অস্থিরতা নিয়ে যখন ফোন করেছি কারণ জানতে চেয়ে, ওপাশ থেকে ভালোবাসার ধমক ভেসে এসেছে, ‘আপনার অসুবিধাটা কী? একাই দেশসেবা করবেন? আমরা মানুষ না?’

কী অসধারণ দুটি শব্দ! ‘সেবা’ এবং ‘মানুষ’। সভ্যতা বিকাশের নানা পর্যায়ে মানুষ কেবলই অধিকতর মানুষ হতে চেয়েছে, এখনো চাইছে। আবার সভ্যতাবিনাশী তৎপরতাও মানুষেরই হাতে সম্প্রসারিত হয়, বহমান থাকে। এসবের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে সমাজের উৎপাদনব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক, নির্দিষ্ট একটি সমাজব্যবস্থায় মানুষের রুচি-সংস্কৃতি অর্থাৎ মনোজগৎ নির্মাণ করে। বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে এখনকার পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক মন ও মানসকে উসকে যায় প্রতিক্ষণ। ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পারস্পরিক ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর সম্পর্ক। মানবতার কণ্ঠনালি ও শ্বাসনালিতে তাই ক্রমাগত চেপে বসে মুনাফা বা লাভ নামের দানবীয় পা। শ্রমিকের ঘাম ঝরে। লাভ হয় মালিকের। ব্যক্তিগত লাভ। অথবা মালিকগোষ্ঠীর। শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার যদি সোচ্চারিত হয় শোষণের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রব্যবস্থা যেহেতু মালিকের পক্ষের, রাষ্ট্রযন্ত্র তখন হয় নিপীড়ক, পেটোয়া বাহিনী নামে পথে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নৈরাজ্য বাড়ে। বাড়ে বিকৃতি। ভয় বাড়ে। নিশ্চুপ থাকা বাড়ে। অস্থিরতা ছুঁয়ে যায় সমাজের দশ দিগন্ত। কখনো কখনো দিশা মেলে না। তখন অদৃষ্টবাদ প্রসারিত করে তার সর্বনাশা থাবা। ক্রমবর্ধমান ক্রোধ ও বিক্ষোভ প্রশমনে রাষ্ট্রের কাঁধে সওয়ার হয় ধর্ম, পারলৌকিক প্রাপ্তির লোভ ও ভয় আত্মকেন্দ্রিকতা ছড়ায়। বাড়ে আস্থাহীনতা। নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না মন।

এই আস্থা নেই বলেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তছনছ হয় হাসপাতাল। মামলায় অভিযুক্ত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ। যেকোনো জীবনেরই মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত এবং বেদনার। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু সংশয়ের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে তাৎক্ষণিক উন্মত্ততা সত্যকে আড়ালে নিয়ে যায়। ধোঁয়াশায় জড়িয়ে রাখে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা কিংবা অদক্ষ চিকিৎসক নেই, এমন নয়। কিন্তু এ রকম তাণ্ডবে তার সুরাহা হবে কি? হয় না। হচ্ছেও না। শৃঙ্খলা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ববোধ আমরা যেমন পরিবার বা সমাজ থেকে শিখি, তেমনি তা শেখার জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক বিরোধাত্মক হলে দুরাচার উদ্বাহু নৃত্য করে। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শ্রমিক, কৃষক ও সংস্কৃতিকর্মীদের একটা যূথবদ্ধ লড়াই ছিল। ছাত্র নিপীড়িত হলে অন্যরা সমস্বরে গর্জে উঠেছে তখন। চিকিৎসক বা শ্রমিকের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্ররা তাতিয়ে তুলেছে রাজপথ। একজন ডা. মিলনের খুন হওয়া সেদিনের গণ-অভ্যুত্থানকে বিস্ফোরিত করেছিল। আর আজ? ফ্যাসিবাদের অজগর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে যখন আমাদের, তখন আমরা যে যার ব্যক্তিগত আঠায় আটকে যাচ্ছি নিরলস।

ব্যাধি সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। কান ধরে উঠবস করা শিক্ষক শ্যামলকান্তি এখন কারাগারে। জানি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অথবা চিকিৎসক, কবি, প্রকৌশলী কিংবা সংস্কৃতিসেবীরা কোনো কর্মসূচি দেবেন কি না। দীর্ঘদিনের প্রতিবাদহীনতা এখন সংক্রামক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সকাল-বিকেল ব্যায়াম করাটাই একমাত্র পথ বলে মনে হয়। আর তার জন্য জনতার পদভারে প্রকম্পিত চত্বরই আলো ও বায়ু চলাচলের বিশুদ্ধ প্রতিবেশ। রবীন্দ্রনাথ অন্যকে অসম্মান করতে না করেছেন বারবার। কেন? আসুন, পাঠ করি।

‘...যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’...

মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।