আড়ি পাতা প্রযুক্তির অবাধ বিকিকিনি কতটা বৈধ

টেলিফোনে আড়ি পাতার খবর আমাদের কাছে খুব নতুন কিছু নয়। নিয়মিতই সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নজনের টেলিফোন আলাপ প্রকাশিত হচ্ছে। কোন সূত্র বা কোথা থেকে এগুলো পাওয়া যায়, তার খোঁজ আমরা জানতে পারি না। টিভি বা সংবাদপত্রগুলো এ ধরনের টেলি আলাপ প্রকাশের ক্ষেত্রে সাধারণত ‘সংলাপটি আমাদের হাতে’ এসেছে বলে উল্লেখ করে। কিন্তু তা কীভাবে রেকর্ড করা হলো বা কারা করল, তা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা বা সরকার তদন্ত করে বের করেছে বলে আমাদের জানা নেই। গতকাল সোমবারও একটি সংবাদপত্রে এমন একটি টেলিফোন আলাপ এবং এর ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (ভিএনএসসি) অধ্যক্ষ কামরুন নাহার এবং ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ফোরামের নেতা মীর সাহাবুদ্দিনের মধ্যে এ টেলিফোন আলাপ হয়েছিল।

এরই মধ্যে দুনিয়াজুড়ে ৫০ হাজারের বেশি টেলিফোনে আড়ি পাতার খবর প্রকাশ করেছে প্যারিসভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। কারা বিশ্বের সেই ৫০ হাজার নাগরিক, তাঁদের পুরো তালিকা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে তদন্ত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা পেশাগত কারণে তাঁরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ, তাতে সন্দেহ নেই। এই গুরুত্বপূর্ণদের মধ্যেও যাঁরা ‘বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ’, এমন কিছু নাম প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান রয়েছেন। আরও রয়েছেন বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও ভিন্নমতাবলম্বীরা।

এই নজরদারি বা টেলিফোনে আড়ি পাতার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি করা পেগাসাস স্পাইওয়্যার। এটা এমনই উন্নত ভার্চ্যুয়াল গোয়েন্দাপ্রযুক্তি, যার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবে ঢুকে কার্যত সেই ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। যে ব্যক্তিকে টার্গেট করা হয়েছে, তাঁর কম্পিউটার বা ফোনের ডিভাইসে দৃশ্যত কোনো নির্দোষ লিংক পাঠানোর মাধ্যমে ডিভাইসটিকে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। ফলে ডিভাইসটির সব ধরনের ডেটা ও তথ্যে প্রবেশাধিকার মেলে। ডিভাইসের সব যোগাযোগের নম্বর, মেইল, মেসেজ বা ছবি—সবকিছুই পাওয়া সম্ভব হয়। ছবি তোলা, ফোনের আলাপ রেকর্ড করা, মাইক্রোফোন ব্যবহার—সবকিছুই দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

ইসরায়েলের এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। কোন কোন দেশ এই প্রযুক্তি কিনেছে, তার পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে এ পর্যন্ত পাওয়া তদন্তের তথ্য অনুযায়ী আজারবাইজান, বাহরাইন, হাঙ্গেরি, ভারত, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, মরক্কো, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার এই পেগাসাস ব্যবহার করেছে। ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসওর দাবি, তারা শুধু সরকারের কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করে। তার মানে ক্রেতাদেশগুলোর সরকারই শুধু টার্গেট করা ব্যক্তির ডিভাইসে অনুপ্রবেশ করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে সরকারগুলো এই প্রযুক্তিকে কী কাজে ব্যবহার করছে? কাদের বিরুদ্ধে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তা ঠিক করে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। এনএসও বলেছে, বিক্রি করা স্পাইওয়্যার সিস্টেম তারা পরিচালনা করে না এবং গ্রাহক সরকারগুলো যাদের টার্গেট করে, তাদের তথ্যে এনএসও ঢুকতে পারে না। তাই গ্রাহক দেশের সরকারগুলো এই স্পাইওয়্যার কাদের ওপর বা কী কাজে ব্যবহার করছে, তা তদারকির সুযোগ তাদের নেই।

এটা বিস্ময়কর যে পেগাসাসের মতো এত সংবেদনশীল স্পাইওয়্যার কেনাবেচার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি, দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি নেই। অথচ এই নজরদারি প্রযুক্তি কীভাবে ও কার ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে দেশগুলোর নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে। আদালতের নির্দেশনা বা সম্ভাব্য কোনো অপরাধীর ক্ষেত্রে ছাড়া অন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর নজরদারির কাজে পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হলে তা নিশ্চিতভাবেই নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে।

ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও দীর্ঘদিন ধরেই ভার্চ্যুয়াল গোয়েন্দা নজরদারির সফটওয়্যার পেগাসাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করে আসছে। পাঁচ বছর আগে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে তারা সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনের জন্য বিশ্বের যেকোনো দেশের বৈধ সরকারের কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করে। এখানে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে কোন দেশের কোন সরকার বৈধ না অবৈধ, তা নির্ধারণের সংজ্ঞা কী? মিয়ানমারে এখন যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তারা বৈধ না অবৈধ? তা ছাড়া ‘বৈধ’ সরকারগুলো এই প্রযুক্তি কী কাজে লাগিয়েছে, তার কিছু নমুনা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।

ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ফরেনসিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এনএসওর ক্রেতাদেশগুলো সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও অ্যাকটিভিস্টদের ফোনে ঢোকার জন্য পেগাসাস স্পাইওয়্যারটি ব্যবহার করেছে। সম্পাদকীয়তে এ ধরনের বাণিজ্য বন্ধ এবং এই বাণিজ্যকে গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বলা হয়েছে, যে অস্ত্রটি অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনের কাজে ব্যবহার করার কথা ছিল, তা এখন বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো নিজের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করেছে। সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ওই সব দেশ যখন এই স্পাইওয়্যার শুধু নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবহার শুরু করবে, তখন কী হবে?

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র তার শক্তি হারাচ্ছে। দেশে দেশে বলশালী হয়ে উঠছে কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদকে টিকিয়ে রাখার এক শক্তিশালী ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে নজরদারি সংস্কৃতি জারি রাখা। কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো চাইবে যেকোনো মূল্যে পেগাসাসের মতো প্রযুক্তি জোগাড় করতে। বৈশ্বিক উদ্যোগ ছাড়া এর বিহিত করা কঠিন।

বিশ্বের যে ৫০ হাজার ফোনে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাদের মধ্যে অন্তত ১৮০ জন সাংবাদিক রয়েছেন বলে তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী বা বিভিন্ন ক্ষেত্রের অ্যাকটিভিস্টরা এমনিতেই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের নজির মেলায় তাদের কার্যক্রম আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। চূড়ান্ত বিচারে যা মতপ্রকাশ ও জানার অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত বা পাল্টাপাল্টি সাইবার যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরিতেও এ ধরনের স্পাইওয়্যার বিপজ্জনক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ পর্যন্ত যে তদন্ত হয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর টেলিফোনে স্পাইওয়্যার ঢুকিয়েছে মরক্কো আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের টেলিফোনে তা ঢুকিয়েছে ভারত। এসব সত্য হলে বা কোনো দেশ যদি অন্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের ফোনে পেগাসাস ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় চলে যায়, তবে তা আন্তসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক অপরাধের পর্যায়ে পড়বে।

পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর এখন এই প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠেছে যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এ ধরনের প্রযুক্তি বিক্রি বা স্থানান্তর করা কতটা বৈধ ও যৌক্তিক। বাজারের চাহিদার তত্ত্ব এখানে আদৌ খাটবে কি? পরমাণু কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ ও বিধ্বংসী দুটি দিকই রয়েছে। সে কারণে কোনো দেশ চাইলেই এই প্রযুক্তি অন্য দেশের কাছে বিক্রি বা স্থানান্তর করতে পারে না। কোন দেশ কী কাজে তা ব্যবহার করছে বা করবে, তার আন্তর্জাতিক তদারকি থাকে। পেগাসাসের মতো প্রযুক্তি স্থানান্তর বা বিক্রির ক্ষেত্রেও কি এমন কোনো তদারকি জরুরি হয়ে পড়েনি? সন্ত্রাস বা অপরাধ দমনের প্রযুক্তি যদি মানবাধিকার ক্ষুণ্ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হরণের কাজে ব্যবহার করা হয়, তবে সেই প্রযুক্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া বা এ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা ছাড়া আর পথ কী?

বাংলাদেশের কারও মুঠোফোনে পেগাসাসের স্পাইওয়্যার অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে কি না বা করা হলে তা কারা করিয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। তবে পেগাসাসই তো সব নয়। পেগাসাসের মতো প্রযুক্তি কেনা ও এর গণব্যবহারের খরচ অনেক বেশি। এ ধরনের আরও অনেক প্রযুক্তি আছে, আছে নানা কায়দা। জবাবদিহিহীন পরিস্থিতি এসব কাজকে আরও সহজ করে দেয়। তা না হলে আমাদের দেশে এত টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হয় কীভাবে?

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র তার শক্তি হারাচ্ছে। দেশে দেশে বলশালী হয়ে উঠছে কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদকে টিকিয়ে রাখার এক শক্তিশালী ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে নজরদারি সংস্কৃতি জারি রাখা। কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো চাইবে যেকোনো মূল্যে পেগাসাসের মতো প্রযুক্তি জোগাড় করতে। বৈশ্বিক উদ্যোগ ছাড়া এর বিহিত করা কঠিন। মতপ্রকাশ ও এর অধিকার রক্ষাসংক্রান্ত জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কায়ই নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রিসংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক বিধিবিধান কার্যকর হওয়ার আগপর্যন্ত তা বিক্রির ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার পক্ষে মত দিয়েছেন।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]