আয়না, তোমাকে দেখছি

প্রয়াত নাট্যজন এস এম সোলায়মান খ্যাতিমান ছিলেন সমাজমনস্ক ও বিদ্রূপাত্মক নাট্য নির্মাণশৈলীর জন্য। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনসীমা মাত্র ২৫ বছরের। এই সময়কালেই তিনি মঞ্চের জন্য রচনা করেছেন মৌলিক ১৩টি নাটক। রূপান্তর করেছেন ১৮টি। খ্যাপা পাগলার প্যঁাচাল নিয়ে প্রথম তিনি দর্শকের সামনে এসেছিলেন ১৯৭৯ সালের ২৩ অক্টোবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে, বটতলায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ এস এম সোলায়মানের সেই থেকে শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ-পীড়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনাচারের বিরুদ্ধে তীব্র সাংস্কৃতিক লড়াই। সময়টা ছিল সেনাশাসক এরশাদের দুঃশাসনের। সেই সময়েই, ১৯৮৫ সালে ‘রংপুর পদাতিক’ নাট্যদলের উদ্যোগে মহড়া শুরু হয়েছিল তাঁর ইঙ্গিত নাটকের। নাটকটি বিরাজমান শিক্ষাব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক শঠতা, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিষয়গুলোকে বিদ্রূপ করে রচিত হয়েছিল।

তো, ইঙ্গিত নাটকের রাজনৈতিক শঠতা ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলপর্বের একটি অংশে রাজা, মন্ত্রী, নাজির, সেনাপতি ও প্রহরীর সংলাপ বিনিময় আছে। জটিলতা তৈরি হলো মন্ত্রী চরিত্রে যিনি অভিনয় করছিলেন, তাঁর সংলাপ উচ্চারণের সময়ে। রাজার নাম বদু। আর মন্ত্রীর নাম চদু। প্রহরী এসে বলে, ‘কিছু লোক বদু রাজার দর্শনপ্রার্থী।’ সেনাপতি: ‘উহারা কি সম্ভ্রান্ত-জাতীয় কেউ?’ প্রহরী: ‘না’। মন্ত্রী: ‘উহারা কি মোটা-তাজা?’ এই ‘মোটা-তাজা’ নিয়েই গোলমাল শুরু হলো। মন্ত্রী চরিত্রের অভিনেতা কিছুতেই মোটার ‘ট’ বর্ণটি উচ্চারণ করতে পারছিলেন না। বারবারই বলছিলেন, ‘উহারা কি মোঠা-তাজা?’ নির্দেশকের ধমক ও তিরস্কারে যদিও-বা ‘মোটা’ ঠিক হলো, ‘তাজা’ হয়ে গেল ‘তাঝা’! এবং চূড়ান্ত মঞ্চায়নের সন্ধ্যায় সেই অভিনেতার অতিরিক্ত সচেতনতায় সংলাপ উচ্চারিত হলো ‘উহারা কি মোঠা-থাঝা?’ দর্শকেরা প্রবল করতালি দিয়েছিলেন সেদিন নিশ্চয়ই এই ভেবে যে আমাদের দেশের রাজা-মন্ত্রী-সেনাপতিরা বাস্তবেই অসংখ্য ভুল ও অবাস্তব কথা জনগণের উদ্দেশে বলেনই তো।

এস এম সোলায়মানের সেই নাটকের চরিত্রগুলো এখন বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায় হাঁটে। প্লাবিত হাওর অঞ্চলের দুর্দশার ধারাবাহিকতায় এখন সিলেট বিভাগের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সর্বগ্রাসী বন্যার থইথই জল। সেই বন্যা দেখে পতিত স্বৈরশাসক এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ বলেছেন, ‘দেশে আল্লাহর গজব পড়েছে; এ জন্য বন্যা হচ্ছে, পাহাড়ধস হচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ৭ জুলাই) আল্লাহ কবে, কখন, কীভাবে এই সংবাদ এরশাদকে দিয়েছিলেন, তা জিজ্ঞাসা করল না কেউ। কিন্তু পাহাড়ধস সম্পর্কে এরশাদের সঙ্গে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিশ্চয়ই একমত নন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপির আমলে চার লাখ মানুষকে পাহাড়ে ঢুকিয়ে পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট করা হয়েছে। সে কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে এমন বিপর্যয় নেমে এসেছে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ১৭ জুন) সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর এই ধরনের মন্তব্য একটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাচ্ছে মনে। পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা সদরে বেশ কয়েকবার নিজেই গিয়েছি বিগত চার বছরে। উপলক্ষ ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-জাতীয়। এসব অনুষ্ঠানে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্য অঙ্গসংগঠনসমূহের বন্ধুরা। এবং সংখ্যায় তাঁরা কম নন। এখন প্রশ্নটা খুব সোজা। বিএনপি বা এরশাদের সামরিক শাসনামলে যারা জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করেছিল পাহাড়ে, তারা কি দলবদল করে এখন আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে? পার্বত্য অঞ্চলের উঁচু-নিচু দেয়াললিখনের কোথাও বিএনপি বা জাতীয় পার্টির কোনো ‘জিন্দাবাদ’ চোখে পড়ল না। সে সময়! উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অশ্লীলতা এখানে নতুন নয়। সাভারের রানা প্লাজা যখন ধসে পড়েছিল, বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভবনটির ফাটল ধরা দেয়াল, স্তম্ভ ও গেট ধরে বিএনপির হরতাল-সমর্থকেরা নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। ধসে পড়ার ক্ষেত্রে এটিও সম্ভাব্য কারণ হতে পারে!

ফাটল ধরা ভবন ও দেয়াল যেমন যেকোনো সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা জিইয়ে রাখে, সমাজও তেমনি। চুনকাম করে বহু রঙের চোখ ধাঁধানো ভবন নির্মাণ করে গৃহস্থ মানুষকে প্রলুব্ধ করার বিজ্ঞাপন যতই দেওয়া হোক না কেন, ভবনের ভিত্তি যদি সুদৃঢ় না হয়, সেখানে বসবাস অনিরাপদ। স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পেও প্রায়ই এখানে ভবন হেলে পড়ে। সমতল ও পাহাড়ে গৃহনির্মাণকৌশল একই রকম হওয়ার কোনো কারণ নেই। অবৈজ্ঞানিকভাবে পাহাড়ের ভিত্তির মাটি কাটলে পাহাড় অটল গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কোন যুক্তিতে? আমাদের সমাজেও এখন রূপকথার মতো প্রেতলোকের খিলখিল হাসি, গাম্ভীর্য নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের যাবতীয় সম্পর্কের মাঝে বিভাজক রেখা হিসেবে হিংস্র ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেছে ধর্ম। এবং নির্দিষ্ট কোনো একটি ধর্ম। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক একটি সরকারি বৈঠকের আলোকচিত্র দেখে আশঙ্কায় শিউরে উঠেছি। একটা উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে এই প্রশ্রয়ের মধ্যেই কি অঙ্কুরিত হয় গ্রামাঞ্চলে জারিগান বন্ধ ও রথযাত্রা বন্ধের সরকারি অগণতান্ত্রিক ঘোষণা?

এখানে এখন প্রশ্ন তোলা, সরকারি ভাষায় ‘উন্নয়নের বিরোধিতা’র সমার্থক। দেশবিধ্বংসী, প্রকৃতিবিধ্বংসী, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনস্বার্থ ধ্বংসমুখী যেকোনো জবরদস্তির বিরুদ্ধে সোচ্চারিত প্রতিবাদ এখানে প্রতিদিন মৃদু স্বরে রূপান্তরিত হচ্ছে। অপহরণ কিংবা গুম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এখানে গণতন্ত্রের চেহারায় বাঙ্‌ময় বলেই হয়তো আমাদের কথা ও লেখাসমূহ বিমূর্ত এখন। কারণ, অপহৃত হয়ে যাঁরা ফিরছেন আল্লাহর ইচ্ছায়, তাঁরা হয় কাঁদছেন, অসংলগ্ন কথা বলছেন, নাহয় হাসপাতালের কেবিনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমাদেরই কেউ কেউ সরকারি ভবনে ইফতারের দাওয়াত খাচ্ছেন। কারও কারও ফেসবুকের ছবিতে চোখে পড়ছে আনুগত্যের কাঁধে হাত রেখে হাসছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ ব্যক্তিরা। এ বড়ই নিদানকাল। মাদ্রাসায় বলাৎকার বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু। বয়লার ফেটে মরে যাচ্ছে শ্রমিক। কৃষকের ধান হাওরের জলে ভেসে গেছে। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৯ শতাংশ। গজবের পর গজব যখন বাংলাদেশে, তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইতালির ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে খোদ পোপকেই বলছেন ক্ষমা চাইতে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাথলিক গির্জার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত কানাডার আবাসিক স্কুলসমূহে শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছিল। (বিবিসি ও সিবিসি, কানাডা, ২৭ মে, ২০১৭) জাস্টিন ট্রুডোও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, অবাক লাগে না?

মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক  সংস্কৃতিকর্মী