ই-কমার্স-এমএলএম প্রতারণা, লোভ সামলাতেই হবে

ছাত্রাবস্থায় ইংরেজি ব্যাকরণে পুরাঘটিত অতীত কাল নিয়ে ঝামেলা পোহানো ছাত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়া’-সংক্রান্ত অতীত কালের উদাহরণটিকে জটিল মনে হতো। কয়েক বছর ধরে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং, অনলাইনে কেনাকাটা এবং ‘লাভজনক’ বিনিয়োগের নামে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাজার কোটি টাকা হাপিশ করার ঘটনা দেখে ‘পাস্ট পারফেক্ট টেন্সের’ এই উদাহরণ এখন আর জটিল মনে হয় না। কারণ, ‘ডাক্তার’ আসার আগেই হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়ে আর্থিকভাবে মারা যান। এসব প্রতারণামূলক কাজ যখন প্রকাশ্যে ঘটতে থাকে, চটকদার বিজ্ঞাপন এবং তারকাদের মডেল বা পণ্যদূত সাজিয়ে সরল মানুষের বিশ্বাসকে যখন কাজে লাগানো হয়, তখন কোনো মহলের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন নজির কম।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও দায়িত্বশীল প্রশাসন বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে বলা হয়, অভিযোগ এলে তারা বিষয়টি ‘খতিয়ে’ দেখবে। অদূর অতীতে যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান যে হাজার হাজার কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে, প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেলেও সে টাকা উদ্ধার করা যায়নি। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব প্রতিষ্ঠানে হাত পাকিয়ে কর্মীদের কেউ নতুন নামে আবার ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। তাঁদের কয়েকজনকে ধরা গেলেও অনেকেই এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতারণা ব্যবসা। ছোট আকারের বলে এদের কর্মকাণ্ড এখনো হয়তো ‘খতিয়ে’ দেখার মতো বড় পরিসরে প্রচার হয়নি।

এসব প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কীর্তি ভুক্তভোগীরা ছাড়া অন্যরা যখন ভুলতে বসেছিল, তখন দেশে ডিজিটাল বিপ্লব শুরু হয়। ফলে ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটিং ইত্যাদি ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন কায়দায় প্রতারণার ব্যবসা যে আবার জেঁকে বসেছে, তার একের পর এক আলামত খুব দ্রুত উদ্‌ঘাটিত হতে শুরু করেছে। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত সেসব খবরের কিছু এ রকম: ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।’ ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ৫৮৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ধামাকা শপিং নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।’

নির্দিষ্ট পণ্য কিনলেই ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ অফার দিয়ে ব্যবসা করছিল ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। অবিশ্বাস্য অফারে লাভবান হওয়ার লোভে আকৃষ্ট হয়ে কতসংখ্যক গ্রাহকের কী পরিমাণ টাকা আটকে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি, তার কোনো সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। এ প্রতারণা ব্যবসায় এবার নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। শরিয়াহভিত্তিক সুদমুক্ত বিনিয়োগের কথা বলে এহসান গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ধর্মপ্রাণ গ্রাহকের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন মূল হোতা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনগণের অর্থ আত্মসাতের পর বিদেশে পাচারের অভিযোগ পেয়েছে।

অবিশ্বাস্য এসব অফার কীভাবে দেওয়া হয়, একটু মাথা খাটালেই সেটা ধরে ফেলা যায়। সদস্য বা গ্রাহকদের ওপর নতুন সদস্য জোগাড়ের ভার থাকলে নতুন সদস্যদের জমা করা টাকা থেকেই পুরোনোদের ‘কমিশন’ অথবা ‘উচ্চ হারে’ মুনাফা দেওয়া সম্ভব। নতুন
প্রতিনিধি বা সদস্যসংখ্যা যত দিন বাড়তে থাকবে, তত দিন এটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু নতুন সদস্যের আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে, অর্থাৎ ক্যাশ ফ্লো থেমে গেলেই সবকিছু গুটিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান উদ্যোক্তারা। একই ব্যাপার ঘটে অবিশ্বাস্য ছাড়ে পণ্য বিক্রির জন্য আগাম নেওয়া টাকার ক্ষেত্রেও।

নতুন নেওয়া আগাম টাকা থেকেই উচ্চ হারের ক্যাশব্যাক এবং অস্বাভাবিক মূল্যছাড় দেওয়া সম্ভব হয় পুরোনোদের। নতুন গ্রাহকের সংখ্যা না বাড়লে কিংবা পণ্য উৎপাদক বাকি দিতে রাজি না হলে ঘোষিত দামে পণ্যটা আর দেওয়া যায় না। ঠিক এটাই ঘটেছে ইভ্যালি কিংবা ই-অরেঞ্জের বেলায়। এ-জাতীয় স্কিম একসময় ধসে পড়তে বাধ্য। কারণ, এসব কোম্পানির প্রতিনিধির সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে, বাজার সম্পৃক্তি তত গাঢ় হবে। ফলে লোভে প্ররোচিত করার মতো যথেষ্ট গ্রাহক বা সদস্য আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

মানুষ যদি লোভকে জয় করতে পারে, তাহলে অর্থবাজারের এসব ব্যবস্থাই সাধারণ মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। একমাত্র তখনই ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা’ যাওয়া কমে যাবে

এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনায়াসে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি এবং এ-জাতীয় লেনদেনের কোনো আভাস পাওয়ামাত্র স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা। দ্বিতীয়ত, ‘ডাক্তার’ আসার আগেই যাতে রোগী মারা না যায়, সে ব্যবস্থা না করা। অর্থাৎ এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপনে অবিশ্বাস্য অফার এবং মুনাফার প্রলোভনে বিবেচনারহিত আচরণ না করা।

আমাদের দেশের বাস্তবতায় স্বল্প শিক্ষিত মানুষেরাই এ-জাতীয় অবিশ্বাস্য প্রতিশ্রুতির বলি হয় বেশি। তবে বিনিয়োগের বিপরীতে বাজারের তুলনায় অস্বাভাবিক উচ্চ হারে মুনাফার হার কিংবা অবিশ্বাস্য ছাড় ও ক্যাশব্যাকের ঘোষণায় প্রলুব্ধ হয়ে বহু শিক্ষিত মানুষ, এমনকি ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। সঞ্চয়ের ওপর ব্যাংক সুদের হার যেখানে ৬ শতাংশের বেশি নেই, সেখানে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদ, কয়েক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া কিংবা বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে পণ্য সরবরাহের প্রলোভন কতখানি বাস্তবসম্মত, এসব বিবেচনায় নিলে এ রকম অবিমৃশ্যকারী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে না।

মানুষ যদি অবাস্তব প্রলোভনে বিভ্রান্ত না হয়, তাহলে প্রতারক গোষ্ঠীর পক্ষে তাদের কষ্টার্জিত আয় হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে সরকারি তরফে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে এই বলে সচেতন করতে হবে, কেউ যাতে দ্রুত টাকা বানানোর চেষ্টা না করেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সুবিবেচনাপ্রসূত সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ভালো মুনাফা অর্জন সম্ভব। সাধারণ মানুষের ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের জন্য পেনশন ফান্ড ও বন্ড মার্কেট তৈরি করা অতি জরুরি। আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ মহল দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি করে আসছে। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ সব বিকশিত বাজারেই নিরাপদ।

মানুষ যদি লোভকে জয় করতে পারে, তাহলে অর্থবাজারের এসব ব্যবস্থাই সাধারণ মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। একমাত্র তখনই ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা’ যাওয়া কমে যাবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার

ই–মেইল: [email protected]