ই-কমার্সটা ফটকাবাজদের হাতে গেল কেন?

প্রতীকী ছবি

একের পর এক ধস নামছে আমাদের ডিজিটাল বাণিজ্যে, যা হওয়ার কথা নয়। গত এক যুগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে নেওয়ার সবচেয়ে বেশি সরকারি সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। অথচ দশা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা কিছুই বুঝিনি বা বুঝি না। একটা সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, যা কিনা এখন দুনিয়ার সব অর্থনীতির চেয়ে ওপরে, আমরা তাকে নিচে নামাতে নামাতে এখন জেলে পুরে দিয়েছি। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ একটা চোরের দেশ, এখানে যাঁরাই নতুন কাজ নিয়ে বাজারে আসবেন, চুরি করাই যেন তাঁদের প্রধান লক্ষ্য। না হলে এমন হবে কেন?

এর প্রধান কারণ, আমরা আসলেই কিছু বুঝিনি, এমনকি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নটা যে কী, সেটাই আমরা ভালো করে উপলব্ধি করিনি। না বুঝে, এমনকি আমি বলব, সামান্য কিছু পড়াশোনা করলেও হতো, কিছু অন্তত বুঝত। কোনো খোঁজখবর না নিয়ে মঞ্চ ফাটিয়ে আমরা ফটকাবাজদের গুণের কীর্তন করে পুরো দেশের মানসম্মান প্রাথমিকের নিচে নামিয়ে এনে এখন বলছি ‘কাউকে ছেড়ে দেব না!’ অথচ ইতিমধ্যে দেশের অগণিত উদ্যমী তরুণেরা আশাবাদী ছিলেন—এখন একটা উপায় বের হবে, আমরা মানুষের বাড়ি বাড়ি পণ্য বিক্রি করে নিজের ও পরিবারকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে পারব। কিন্তু কাজের কাজ কী হলো?

কেন পড়েনি বলছি, ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একদল ফটকাবাজ বাজারে নামে। যার অন্যতম সাক্ষী আমরা, যাঁরা এই নিয়ে সেই তখন থেকে কাজ করছি বা হইচই করে তাঁদের বাধা দিয়ে গাড়িটা সোজা রাস্তায় রাখার চেষ্টা করছি। এখন যাঁরা এটা-ওটা বলেন, তাঁদের তখন জন্মের পরের শিশুকাল, তাই তাঁদের অনেক কিছু জানার কথা নয়, পড়ে নেওয়ার কথাটা আসছে তাই। তাঁদের জন্য তখনকার কিছু পত্রিকা, কিছু রচনা আর নিদেনপক্ষে ‘কম্পিউটার জগৎ’ পত্রিকার কপিগুলো পড়ে নেওয়ার সুযোগ এখনো আছে। চাইলে আমি এই পত্রিকার ঠিকানাটাও দিয়ে দিতে পারব।

নব্বইয়ের দশকে কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়ার নামে পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠল ‘ট্রেনিং সেন্টার’। বেশির ভাগই মাড়োয়ারি, ছলচাতুরীর ইংরেজি বলার কায়দা রপ্ত কিছু ছেলে-পেলে প্রতিবেশী দেশ থেকে ভাড়া করে এনে দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন পুঁতে দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে সটকে পড়ল। বোঝাল ‘কম্পিউটার ছাড়া উপায় নাই’, ‘কম্পিউটার না জানা থাকলে চাকরি হবে না’ এসব বলে কয়ে যখন কাজ শেষ, তখন বলল ‘ডেটা এন্ট্রি’-এর কাজ শিখতে হবে, বিদেশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঘরে বসে কামাই হবে’। এর পর বাজারে এল ‘মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন’ নামে আরেক ফাটকাবাজি কাজের প্রলোভন—‘শিখলে ঘরে বসে বিদেশি ডাক্তারের কাজ করে দিয়ে অনেক টাকা অর্জনের সুযোগ!’

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শুরুতে আমরা এগুলো পড়ে নিলাম না কেন? আগের সব কৌশল রূপান্তরিত হতে থাকল, এল ‘আউটসোর্স’ প্রশিক্ষণ নামের আরেক মোহের অপচয়; বাজারে এল দেশের সব কাজ আমরা ‘অ্যাপ বানিয়ে হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেব’ নামের ব্যবসা। দেখলাম সবই জারিজুরি, ওয়েবসাইটের মোবাইল ভার্সন কিছুদিন পাওয়া গেল অ্যাপ নামে, তারপর সব হাওয়া, খরচ কোথায় গেছে কে জানে!

জাতিসংঘ ২০০৩ সালে সর্বদেশসম্মত তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ব ঘোষণাপত্র তৈরি করেছে।সেখানে কোন দেশ কী করবে তার আউট লাইন বিধৃত আছে। আমাদের সেটা ভালো করে পড়ে নেওয়া দরকার ছিল। প্রতিবছর সেই ঘোষণাপত্রের অগ্রগতি নিয়ে পাতায় পাতায় আলোচনা হয়, বাংলাদেশ সেখানে অংশও নেয়, তাদের পুরস্কার নেয় কিন্তু আসল ঘোষণাপত্র পড়ে দেখেনি। কারণ, সেখানে এক জায়গায় লেখা আছে সরকারগুলো ওই ঘোষণাপত্রের ১১টি অ্যাকশন লাইন বাস্তবায়ন করতে ‘উপযুক্ত পরিবেশ’ (ইনেবলিং এনভায়রনমেন্ট) তৈরি করবে। আমরা কি করেছিলাম? তাহলে ১২ বছর লাগল কেন ই-কমার্স নীতিমালা তৈরি হতে? পড়ি তো নাই-ই, ইংরেজি মিডিয়ামের তথাকথিত কন্সালট্যান্টেরা বুঝেছে কি না, সেটা নিয়ে এখন আর একটা প্রকল্প হতে পারে।

জাতিসংঘ সেই ঘোষণাপত্রে ইন্টারনেট শাসন-পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবছর সভা করে (ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম-আইজিএফ), বাংলাদেশ যায়, কিন্তু সেই আইজিএফের কথাও কি কেউ মেনে চলে? তাহলেও ই-কমার্সের এই দশা হতো না। আশপাশের নানা দেশে ও উন্নত দেশগুলোতে কীভাবে এসব নীতিমালা করা হয়েছে, কীভাবে সেসব দেশে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, শাসন-কার্য চলছে সেগুলো ভালোভাবে পড়ে ও বুঝে যদি ‘নকল না করে’ আমরা নিজেদের মতো এগোতে পারতাম, তাহলে আমাদের এই দশা হতো না। নকলের কথা বলছি এই কারণে, দুর্ভাগ্যবশত দেখলাম ভারতের টেলিমেডিসিন গাইডলাইন আর আমাদের গাইডলাইন একই ধরনের! পত্রিকায় এ নিয়ে কিছুদিন লেখালেখি হলেও আমরা আমাদের সব সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মতো করে এটা তৈরি করতে পারিনি। কারণ, আমরা অর্বাচীন কিছু ইংলিশ মিডিয়ামের বিশেষজ্ঞ জোগাড় করেছি, যাঁরা দেশের মূল বাস্তবতা বুঝে সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন না বা জানেন না।

এই ই-কমার্স নিয়ে কত মানুষ কত স্বপ্ন দেখেছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা ডেলিভারিম্যান হিসেবে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাসিমুখে পণ্য পৌঁছে দিয়ে হয়তো দুটো পয়সা ফি হিসেবে পেতে পারত। আমরা তাদের এখন অবিশ্বাসী আর মিথ্যাবাদী মানুষের দলে ঠেলে দিলাম। কত মা-বোনেরা আশা করেছিলেন, বাড়ি বসে তাঁর হাতের কাজ বিক্রি করতে পারবেন। হতাশায় এখন তাঁদের আমরা কোথায় নিয়ে গেলাম! ই-কমার্স কি শুধু মোটরসাইকেল আর টেলিভিশন বিক্রির বাজার হয়? কখন হয়? সে সক্ষমতা কি আমরা তৈরি করেছিলাম?

আর আমরা বেচা-বিক্রিওয়ালাদের সঙ্গে মঞ্চে না উঠে, তাঁদের চটকদার বিজ্ঞাপনের গুণগান না করে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাই না কেন, ‘জিনিসটা যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন, না হলে আমাকে বলুন, আমি দেখছি’—এসব কথা বলি না কেন?

কারণ, আমরা মানুষের দলে থাকতে পারি না বা চাই না। আমরা টাকাওয়ালা ও ফটকাবাজদের পাশে থাকি। কিন্তু তাঁদেরও চিনতে পারি না। আমরা মনে রাখি না এই সরকার মানুষের মানবিক সরকার, আমাদের আরও বুঝেশুনে এগোনো দরকার ছিল। বুঝতে পারলে দেশের ও দশের উপকার হতো।

রেজা সেলিম আমাদের গ্রাম, উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পের পরিচালক।
ই-মেইল: [email protected]