ইউএনও ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের মিলেমিশে চলা

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের জাতীয় পর্যায়ের সংগঠনের পক্ষ থেকে দিন কয়েক আগে ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সম্মেলনে তাঁদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘উপজেলায় শাসকের ভূমিকায় উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও)’। সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য প্রথম আলোসহ দেশের সব সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। এ নিয়ে বিভিন্ন দৈনিকে লেখা হয় সম্পাদকীয়। উপজেলা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের এ বক্তব্য গুরুত্ব পাওয়াই স্বাভাবিক ও সংগত। আর অভিযোগটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। অভিযোগের মর্ম হচ্ছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সবকিছুতেই তাচ্ছিল্য দেখান। ইউএনওদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব তাঁদের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, আইনে উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁদের দাবি অনুসারে এর প্রশাসনিক কাঠামো হলো নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ। আর উপজেলা পরিষদসংক্রান্ত আইনে ১২টি মন্ত্রণালয়ে ১৭টি বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মাঠপর্যায়ে তাঁদের কার্যাবলিসহ উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও অভিযোগ করা হয়, আইনকে বিবেচনায় না নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বিভিন্ন সময়ে পরিপত্র জারি করে আসছে। এসব পরিপত্রে উপজেলার সব বিভাগের কার্যাবলি নিষ্পত্তির জন্য গঠিত কমিটিগুলোতে ইউএনওদের করা হয়েছে সভাপতি। আর চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়াই সব কাজ কমিটিপ্রধানের ক্ষমতাবলে ইউএনও নিয়ন্ত্রণ করছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে কাজ সম্পাদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের জারি করা একাধিক পরিপত্র ইউএনওরা মানছেন না।

সংবাদ সম্মেলনের মর্ম অনুসারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলেও ইউএনও তাঁদের উপেক্ষা করে উপজেলায় শাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিহীন প্রশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংবিধান, আইন ও প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে বিপদে পড়েন। যেকোনো ইস্যু সৃষ্টি করে নির্বাহী তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের অপসারণ করা হয়। এভাবে পরিকল্পিত ছকে স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি ও জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ নষ্ট করা হচ্ছে।

অভিযোগের আকৃতি ও প্রকৃতি গুরুত্ব বহন করে। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাঁদের অবস্থানে এসেছেন। উপজেলা পরিষদ সুনির্দিষ্ট আইন ও সরকারি বিধিবিধান অনুসরণে গণতান্ত্রিক কাঠামোতেই চলার কথা। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় এ কাঠামোয় ক্ষমতার রশি-টানাটানি সূচনা থেকেই ছিল।

১৯৮২ সালে যখন এটা গঠিত হয়, তখনই কেউ কেউ এর কাঠামোগত অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলো অমীমাংসিত রেখেই চলছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রধান অসংগতি হলো প্রতিষ্ঠানটি ষোলো আনা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা–কর্মচারী দিয়ে চলছে। এমনটা দেশের আর কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নেই। শুরুর দিকে তখনকার রাষ্ট্রপতি এরশাদ তৃণমূলে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়নের চেয়ে নিজের একটি বেসামরিক প্রভাববলয় গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে বরখাস্ত, সব ক্ষমতা শুরুতে উপজেলা পরিষদকে দেওয়া হয়েছিল। কদিন বাদেই তাদের শক্তিশালী সমিতির দাবিতে তা-ও রদ হয়ে যায়। যেসব দপ্তর সংস্থাকে উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে, তাদের রয়েছে একটি জেলা অফিস। এসব দপ্তর সংস্থার কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অধীনেও কাজ করছেন। শুনতে হচ্ছে তাঁদের আদেশ-নির্দেশ।

এ দ্বৈত শাসনব্যবস্থার ওপর ২০০৯ সালে স্থানীয় সাংসদদের (এমপি) পরিষদের উপদেষ্টা করায় কর্মকর্তাদের ওপর তিনজনের খবরদারি চেপেছে। সাংসদদের প্রভাববলয় অনেক ক্ষেত্রে অপরিসীম। কেউ কেউ পরিষদ সভা কবে ডাকা হবে, সে নির্দেশও দেন। দেশের বিরাজমান প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইউএনওরা এমপিকেও উপেক্ষা করতে পারেন না। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাংসদেরা এখন সাধারণত একই দলের হলেও নিজেদের প্রভাব–প্রতিপত্তি বিস্তারে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বী। এ বিষয়গুলো সংবাদ সম্মেলনে উঠে আসেনি।

কিন্তু এরপরও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের তাঁদের আইনগত প্রাপ্য মর্যাদা ও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা চলে না। হস্তান্তরিত বিষয় বলে যেগুলো নির্দিষ্ট করা আছে, সেখানে আইন অনুযায়ী দায়িত্ব সম্পাদন করতে উপজেলা পরিষদ ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আর পরিষদের প্রধান নির্বাহী এর চেয়ারম্যান। পক্ষান্তরে, এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন ইউএনওরা। তাঁদেরও সুনির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহি রয়েছে। সরকারের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করাও এর আওতায় পড়ে। সুতরাং কোনো ব্যয় অনুমোদন সুপারিশ করার আগে ইউএনওকে নিশ্চিত করতে হয় এর যথার্থতা সম্পর্কে। আর অবশ্য তা তিনি করবেন চেয়ারম্যানকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েই। সংশ্লিষ্ট আইনের বিধানগুলো তাঁকে ব্যাখ্যা করতে হবে চেয়ারম্যানের কাছে। যেমনটা মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা করেন মন্ত্রীদের কাছে। সম্পর্কটা মোটামুটি একই ধরনের। এ অবস্থান চেয়ারম্যানদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তবে কোনো ইউএনও অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো নথি আটকে রাখলে বা বিরূপ মন্তব্য করলে চেয়ারম্যান বিষয়টি ত্বরিত জেলা প্রশাসককে জানাতে পারেন। জানাতে পারেন সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও। এমনটা কোনো ইউএনও করেন না তা বলা যাবে না। এ ধরনের অভিযোগ এলে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। আর তা বিবেচিত হবে ইউএনওর অযোগ্যতা বলে। ঠিক তেমনি ইউএনওকে দিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নথি সই করিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো কোনো চেয়ারম্যানের চাপ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে অসৌজন্যমূলক আচরণেরও। উভয় পক্ষ পারস্পরিক আইনগত অবস্থান উপলব্ধি করলে এমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা অবগত আছেন, ইউএনওর সব দায়িত্ব পরিষদের আওতাধীন নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উচ্ছেদ অভিযানসহ বেশ কিছু বিষয় সরকারের সংরক্ষিত। এসব বিষয়ে ইউএনওরা সুনির্দিষ্ট আইন, বিধিবিধান অনুসারে দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলা পরিষদের কাছে এসব বিষয়ে জবাবদিহির বিধান নেই। তবে এ–জাতীয় বিষয়েও কিছু ক্ষেত্রে জনসমর্থনের প্রয়োজন থাকে। সুতরাং আবশ্যক বিবেচিত হলে এসব বিষয়ের কিছু কিছু ইউএনও চেয়ারম্যানকে অবগত রাখতে পারেন। কর্মকৌশল নিয়েও নিতে পারেন তাঁর পরামর্শ। এমনটা সফলভাবে করা গেলে এসব কার্যক্রমের বিরোধিতাকারী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে শক্তিপ্রয়োগ করতে হবে তুলনামূলক কম। বিষয়গুলো নির্ভর করবে ইউএনও এবং চেয়ারম্যানের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। উভয়ে উভয়কে সম্মান করে পারস্পরিক গুরুত্ব উপলব্ধি করলে ভুল-বোঝাবুঝি তেমন একটা থাকবে না। উল্লেখ্য, সংরক্ষিত বিষয়ে চেয়ারম্যান কোনো নির্দেশ দিতে না পারলেও কোনো অনিয়ম দেখলে ইউএনওকে সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিতে পারেন। এমনকি অবগত করতে পারেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।

সমিতি সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট একটি দাবিনামা দিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের এগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা আবশ্যক। কোনো পরিপত্র বা নির্দেশিকা আইন ও বিধির পরিপন্থী হলে তা সংশোধন ও প্রয়োজনে বাতিল করতে হবে। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত উপজেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৮৫ সালে। পরেরটি ১৯৯০-এ। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে পদ্ধতিটিই বাতিল করে দেয়।

আবার চালু হয় জাতীয় নির্বাচনের পরপর ২০০৯-এর সূচনায়। তবে ১৯৯১ সালে তুলে নিয়ে আসা দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতগুলো আর ফেরত যায়নি উপজেলায়। এরপরও ব্যবস্থাটি চলছে। জনগণের দোরগোড়ায় রয়েছে প্রশাসন ও উন্নয়ন। সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করলে ব্যবস্থাটি পাবে স্থায়ী রূপ। অধিকতর উন্নত হবে বিধিবিধান। গ্রহণযোগ্য হবে সব পক্ষের কাছে। সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে নয়। ধীরস্থিরভাবে কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। এটা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। আমরা চাই কার্যকর উপজেলা পরিষদ।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]