ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমের ভাবনায় রদবদলের আভাস

ইউক্রেনে যুদ্ধে রাশিয়া আসন্ন পরাজয় নিয়ে পশ্চিমের সব সংবাদমাধ্যম একজোট হয়ে যে খবর দিয়েছে তার প্রায় সিংহভাগই বানোয়াট।ছবি : রয়টার্স

রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে যুদ্ধের যে দিকটির ওপর পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের নেতৃত্বের পাশাপাশি সেসব দেশের সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে, তা হলো রাশিয়ার দ্রুত এবং সম্ভাব্য পরাজয়। যুদ্ধের একেবারে শুরুতে রুশ বাহিনী ঝটিকা গতিতে অগ্রসর হয়ে কিয়েভের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে এদের অনেকেই তখন কিছুটা বিভ্রান্তকর অবস্থা থেকে ইউক্রেনের সম্ভাব্য পরাজয়ের কথা বললেও অল্প দিনেই সেই মূল্যায়ন তারা বদল করে নেয় এবং রাশিয়াকে সম্মিলিতভাবে কোণঠাসা করার ওপর আলোকপাত শুরু করে।

পশ্চিমের সেই অবস্থানের ফলাফল হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এদের ইতিহাসের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ। জো বাইডেন তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে বসেছিলেন যে এমন নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে রাশিয়াকে তিনি আটকে দেবেন, যার ফলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা রাশিয়ার হবে এবং দেশটি ইউক্রেন থেকে লেজ গুটিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হবে। এ রকম পূর্বাভাষও তিনি দিয়েছিলেন যে নিষেধাজ্ঞার ফলে ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে পড়ে যাওয়া রাশিয়ার জনগণ পুতিনকে ঝাঁটাপেটা করে বিদায় দিয়ে সভ্য সমাজে দেশটির ফিরে আসা নিশ্চিত করে নেবে।

পশ্চিমা বিশ্বের নেতা হিসেবে গণ্য দেশটির রাষ্ট্রপ্রধানের এ রকম দম্ভোক্তির সঙ্গে গলা মিলিয়ে পশ্চিমের তো বটেই, এমনকি আমাদের দেশের কিছু সংবাদমাধ্যমও পুতিনবধে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। পুতিনের পাশাপাশি রাশিয়াকেও এমন এক জঘন্য রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে, যে দেশের সবটাই যেন পশ্চিমের তুলনায় ভয়ংকর রকম পিছিয়ে পড়া এবং সে রকম এক দেশের আরও জঘন্য এক নেতাকে যেকোনো উপায়ে সরিয়ে দেওয়া না হলে বিশ্বের জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষমাণ।

ইউক্রেনে যুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে রাশিয়ার আসন্ন পরাজয় ও বিপন্নের পথে দেশটির ধাবিত হওয়ার ধুয়া তুলে পশ্চিমের সব রকম সংবাদমাধ্যম একজোট হয়ে ইউক্রেনের যে বিজয়গাথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে শুরু করে, এর প্রায় সিংহভাগই ছিল বানোয়াট সংবাদে পরিপূর্ণ। পাঠকেরা নিশ্চয় কিয়েভের সেই তথাকথিত বীরের কাহিনি ভুলে যাননি, পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম যার বন্দনা গেয়েছিল আমাদের যুগের এক মহানায়ক হিসেবে। পরে জানা যায়, এককভাবে চালানো প্রচেষ্টায় রাশিয়ার ৬০টির বেশি বিমান মধ্য আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া সেই বীরের কাহিনি হচ্ছে ভিডিও গেমস থেকে নেওয়া, বাস্তবে যার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই।

এদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরাও ইউক্রেন প্রসঙ্গে জো বাইডেনের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে ক্রমেই আরও অনেক বেশি সোচ্চার হতে শুরু করায় যে স্পষ্ট ইঙ্গিত এটা দিচ্ছে, তা হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার দিনগুলোর মতো মার্কিন জনমত কিংবা দেশটির রাজনৈতিক অবস্থান—কোনোটাই এখন আর সে রকম সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় নেই।

একইভাবে ওদেসার অদূরের দ্বীপ অস্ত্রাভ স্নেজনিতে রুশ বাহিনীর অবতরণের পর এমন বানোয়াট খবর পশ্চিম ছেড়েছিল, যেখানে বলা হয় যে দ্বীপে অবস্থানরত ইউক্রেনের ১৭ জন নৌসেনা রুশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করে গুলি ছুড়লে রুশরা ভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ইউক্রেনের সরকার ঘটনা আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য বিলম্ব না করে তাদের সবাইকে দেশের বীর খেতাবে ভূষিত করে। পরে জানা যায় যে রুশ সেনাদের দ্বীপে অবতরণ করতে দেখে বিনা বাক্যে এরা সবাই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল। রাশিয়া যুদ্ধবন্দীদের শিবিরে এদের অবস্থানের ছবি প্রকাশ করলে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি ইউক্রেনের সরকারও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে এবং এমন এক ভাব দেখাতে শুরু করে যে বিষয়টি যেন তাদের একেবারেই অজানা।

ইউক্রেনকে কেন্দ্রে রেখে দেখা দেওয়া সে রকম এক অবস্থা নিশ্চিতভাবেই ১৯৩০-এর দশকের জার্মানির কথা আমাদের সহজে মনে করিয়ে দেয়। হিটলারের সেই জার্মানি, যে দেশের প্রচার বিভাগের প্রধান ইয়োজেফ গোয়েবেলস যখন বলেছিলেন যে একটি মিথ্যাকে দশবার সত্য হিসেবে তুলে ধরা হলে যাদের কাছে সেটা বলা, তারা সেটাকে সত্য হিসেবেই মেনে নেবে। পশ্চিমা বিশ্বের আজকের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জার্মানির হিটলারের পার্থক্য তাই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অন্যদিকে, যেকোনো উপায়ে রাশিয়াকে হেয় করে দর্শক-পাঠকের সামনে তুলে ধরার এ প্রচেষ্টার বেলায় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে বিদ্যমান যে পার্থক্য, তা যেন একেবারেই বিলুপ্ত। একই সুরে কথা বলছে কট্টর অবস্থানের জন্য পরিচিত ফক্স নিউজের পাশাপাশি নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনে করা নিয়ে বুক চিতিয়ে গর্ব করে যাওয়া বিবিসি কিংবা নিউইয়র্ক টাইমস।

ইদানীং মনে হয় হাওয়া কিছুটা হলেও ভিন্ন পথে বাঁক নিতে শুরু করেছে। পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম খুব অল্প সময়ে নিজেদের প্রত্যাশিত সাফল্যের দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকলেও রুশ অভিযান তৃতীয় মাসে পদার্পণ করতে যাওয়ার আগে এখন মনে হয় কিছুটা স্বপ্নভঙ্গ এদের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে এবং সেসব দেশের নেতারাও বিভ্রান্তির ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসার উপায় এখন খুঁজে দেখতে শুরু করেছেন। এ কারণে তাঁদের সেই প্রথম দিকের মারকুটে মেজাজ ক্রমেই যেন স্তিমিত হয়ে আসছে এবং কথাও তাঁরা ইদানীং বলছেন আগের চেয়ে অনেক কম। শুধু তা-ই নয়, মাত্র দুই মাস আগেও যখন মনে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সব কয়টি দেশেই ইউক্রেনের পক্ষে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া অবস্থান নিয়ে পুরো দেশ এবং সেসব দেশের জোট একীভূত, সেই ঐক্যেও এখন নিশ্চিতভাবেই ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে। হাঙ্গেরি তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে বসে আছে, নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা দেশটির পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি ইতালি ও জার্মানিও ভিন্ন সুরে কথা বলা শুরু করেছে। জেলেনস্কি এখন আর এদের চোখে তেমন আদরের সন্তান নন, বরং অনেকেই কৌতুক অভিনেতা থেকে রাজনীতিতে উত্তরণ ঘটা সেই ব্যক্তিকে দেখতে শুরু করেছে এক বিড়ম্বনা হিসেবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়।

আরও পড়ুন

মাত্র কিছুদিন আগে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে ইউক্রেনকে ৪ হাজার কোটি ডলার সাহায্য প্রদানের একটি বিলের ওপর ভোট গ্রহণে পরিষদের ৫৭ সদস্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেই উদ্যোগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিরোধিতা যাঁরা করেছেন, তাঁদের অনেকেই বিলটিকে দেখেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পাঁয়তারা হিসেবে। বিতর্কে অংশ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের এক সদস্য এ রকমও বলেছেন, ‘এক বছর আগে বন্দুকধারী একদল ছাগলপালকের হাতে যুদ্ধে আমরা হেরেছি এবং সেই আমরাই কিনা এখন এমন এক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, যে দেশের কাছে আছে ছয় হাজার পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র।’

প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির সদস্য ম্যাট গোয়েটজ মনে করেন, ইউক্রেনকে এতটা বিশাল অঙ্কের সাহায্য প্রদানের বিল অনুমোদন করা হলে যুক্তরাষ্ট্রকে তা নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পথে নিয়ে যাবে এবং সে রকম যুদ্ধ ওয়াশিংটনের জন্য কোনো অর্থ বহন করতে পারে, মার্কিন কংগ্রেসের সহযোগী সদস্যদের তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই ওপরে উল্লেখ করা মন্তব্য তিনি করেন। গোয়েটজ আরও বলেছেন, কিয়েভকে দিতে যাওয়া অর্থের বড় এক অংশ যাবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেটে, ঠিক যেমনটা দেখা গেছে আফগানিস্তানের বেলায়। ফলে, তিনি বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দেশের করদাতাদের অর্থ নাগরিকদের কল্যাণে খরচ করা হবে অনেক বেশি যুক্তিসংগত এবং অর্থবহ।

আরও পড়ুন

এদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরাও ইউক্রেন প্রসঙ্গে জো বাইডেনের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে ক্রমেই আরও অনেক বেশি সোচ্চার হতে শুরু করায় যে স্পষ্ট ইঙ্গিত এটা দিচ্ছে, তা হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার দিনগুলোর মতো মার্কিন জনমত কিংবা দেশটির রাজনৈতিক অবস্থান—কোনোটাই এখন আর সে রকম সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় নেই। ট্রাম্পপুত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র নিজের সামাজিক ওয়েবসাইটে একটি কার্টুন যুক্ত করেছেন, যেখানে দেখা যায়, নাইট ক্লাবে অর্ধ-উলঙ্গ নারীদের নৃত্য দেখানোর জন্য যেসব রড থাকে, সে রকম একটি রড ধরে নেংটি পরা অবস্থায় নেচে চলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি; জো বাইডেন তাঁর দেহে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ডলারের নোট। এর নিচে এ রকম মন্তব্য তিনি করেছেন, ‘চার হাজার কোটি ডলার! টাকার বৃষ্টি হচ্ছে ইউক্রেনে! অন্যদিকে কষ্টে আছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। শিশুখাদ্যের ঘাটতি এখন দেশজুড়ে। চমৎকার কাজ, সাথিরা! এর মধ্যে মাত্র সাত ডলার আসলেই যাবে ইউক্রেনের সাহায্যে, আর বাকিটার গন্তব্য হবে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাজনীতিকদের পকেটে।’

মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক