ইউক্রেন–তাইওয়ান ঘিরে যুদ্ধের দামামা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে?

ইউক্রেন ও তাইওয়ান পরিস্থিতি দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও চীনকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। বিপরীতে আছে যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: এএফপি

ভালো নেই আমাদের এই ধরিত্রীর স্বাস্থ্য। মানুষের লাগামহীন লালসার চাপে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা আমাদের চারপাশের পরিবেশের। অন্যদিকে কেবল মারা যাওয়া নয়, চিরদিনের জন্য এই জগৎ থেকে নিয়মিত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অগণিত প্রজাতি এবং সেটাও হচ্ছে আমাদের অফুরান আকাঙ্ক্ষার ফাঁদে অজান্তে পা দিয়ে। অন্যদিকে আমরা যারা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বুক চিতিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করি না, তারাও ভালো নেই নানা চাপের মধ্যে পিষ্ট হয়ে বেঁচে থেকে। চোখে না দেখা করোনাভাইরাস জীবাণু দেখিয়ে দিয়েছে নিজের সাফল্য নিয়ে গৌরব বোধ করার কিছুই আমাদের নেই, কেননা, এর সবটাই ঠুনকো এবং মুহূর্তের ভুলে ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে আমাদের সব রকম হিসাব-নিকাশ। সভ্যতার সেই সূচনালগ্ন থেকে বারবার হোঁচট খেয়েও সেই বোধোদয় যে আমাদের আজও হয়নি, বিশ্বরাজনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি মনে হয় সে কথাই আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল বিশ্বের পাঁচ কোটির বেশি মানুষ। যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কারণে আরও যে কয়েক কোটিকে প্রাণ দিতে হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, সেই হিসাব অবশ্য এর মধ্যে ধরা হয়নি। ফলে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা হবে আনুষ্ঠানিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। হিসাবের বাইরে থেকে যাওয়া এসব মৃত্যুর বড় এক অংশ যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে ঘটে যাওয়ায় সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে একসময় যারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, এদের অনেকেই যুদ্ধ যে কী, তার কোনো হদিস কখনোই করে উঠতে পারেনি।

আমাদের বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথাই ধরুন। অনেকেই এখন এর জন্য চার্চিলের বর্ণবাদী আচরণকে দায়ী করে থাকেন। তবে যে সত্য আমরা এড়িয়ে যেতে পছন্দ করি তা হলো, চার্চিল তাঁর এই নীতি বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন দেশের ভেতরের একটি শ্রেণির সহযোগিতা নিয়ে, বাংলার মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে খাদ্যের চালান যাঁরা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যুদ্ধ ফ্রন্টে এবং সেই সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন ধনকুবের এবং সেটা হয়েছিলেন লাশের ওপর পা ফেলে। অন্যদিকে প্রাণ যারা হারিয়েছে, তারা ভাবতেও পারেনি যে তাদের সেই করুণ পরিণতির পেছনে ছিল দূরে কোথাও চলতে থাকা যুদ্ধ, যার সঙ্গে এদের ছিল না বিন্দুমাত্র সম্পর্ক। যুদ্ধের এই দিকটি মনে হয় সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিক।

ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে আরও একটি সর্বগ্রাসী যুদ্ধ বিশ্বে শুরু হতে যাচ্ছে কি না এবং সেই যুদ্ধ শুরু হলে কে হবে বিজয়ী আর কে হারিয়ে যাবে পরাজিত শক্তি হিসেবে ইতিহাসের অন্ধকারে, সেই হিসাব সমরবিশারদেরা সমানে করে গেলেও বিশ্বজুড়ে এখন বড়ই আকাল চলছে শান্তিকামী মানুষের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে ছোট হয়ে আসা আমাদের এই পৃথিবীতে দূরে কোথাও যুদ্ধ শুরু হলে এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা কারও পক্ষেই এখন আর সম্ভব নয়। ফলে আমাদের ঘরের আঙিনা থেকে অনেক দূরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে আমাদেরও শঙ্কিত হতে হয় এ কারণে যে এর থেকে মুক্ত থেকে আনন্দের জীবন আমরা যে কাটাতে পারব, সে রকম মনে করে নেওয়ার কোনো রকম সুযোগ এখন একেবারেই নেই। এ কারণে আরও নেই যে মারণাস্ত্র গবেষণায় অভাবনীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করে দিচ্ছে যে আগামীর বড় কোনো যুদ্ধে পরাজিত হবে একক কোনো দেশ বা ভূখণ্ড নয়, বরং মানবসভ্যতা। আর তাই অনেক দূরে কোথাও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে আমাদেরও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হয়, বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হয় যে যুদ্ধের অধিকার একক কোনো রাষ্ট্র কিংবা যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের নিয়ে গড়ে ওঠা কোনো জোট কিংবা বলয়ের নেই এবং তা থাকতে পারে না। এখানেই মনে হয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে দেখা দেওয়া উত্তেজনায় আমরা, বিশেষ করে আমাদের সংবাদমাধ্যম অজান্তেই হয়ে উঠছি যুদ্ধের একটি পক্ষ। ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করছি যে পক্ষের হয়ে কথা আমি বলছি, সেই পক্ষের অবস্থানকে যুক্তিসংগত প্রমাণ করতে।

একালে যুদ্ধ যে সবাই করছে, তা অবশ্য নয়। যুদ্ধ যারা করছে এবং যুদ্ধের পেছনে মূল মদদ যারা দিয়ে চলেছে, সেই তালিকা কিন্তু খুবই সীমিত। তবে সংখ্যায় সীমিত হলেও অর্থ এবং সমরবলের দিক থেকে এদের ধারেকাছে অন্য কেউ না থাকায় যুদ্ধকে এরা ধরে নিচ্ছে নিজের একতরফা এখতিয়ার হিসেবে এবং অন্য কেউ সেই পথে পা বাড়ানোর চেষ্টা করলে মুহূর্তেই এরা চড়াও হচ্ছে তাদের ওপর। চলতি শতকের সূচনালগ্নে ইরাক ও লিবিয়া এবং আরও কিছুটা পরে আফগানিস্তানে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলি সেই প্রমাণ দিচ্ছে না কি? ইরান যেন কোনো অবস্থাতেই নিজের সমরবল বৃদ্ধি করতে না পারে, সেই চেষ্টা পশ্চিমের শক্তিধর দেশগুলো করে যাচ্ছে পাঁচ দশক ধরে। অথচ নিজেদের শক্তির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার কোনো ইচ্ছা এদের আদৌ আছে বলে এখনো প্রমাণিত হয়নি।

যুদ্ধ নিয়ে এ রকম কানামাছি ভোঁ ভোঁ চলতে থাকা অবস্থায় পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ জানানো শক্তি হিসেবে রাশিয়ার ময়দানে ফিরে আসা এবং চীনের উত্থান সাম্প্রতিক সময়ে সনাতন যুদ্ধবাজদের দুশ্চিন্তা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সেই দুই দেশকে ঠেকাতে নিজেদের বরকন্দাজদের এরা এখন লেলিয়ে দিচ্ছে রাশিয়া এবং চীনের বিরুদ্ধে। পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমের নতুন বরকন্দাজ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তেজনা। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমের বরকন্দাজ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে তাইওয়ান। ফলে এখানেও থেমে নেই যুদ্ধপ্রস্তুতি, যে প্রস্তুতির সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো কয়েকটি দেশ।

তবে কেউ কিন্তু বলছে না কোথায় আমাদের নিয়ে যেতে পারে এ রকম হুংকার তোলা যুদ্ধের প্রস্তুতি, যেটাকে অন্যভাবে সহজেই ‘ফোনি ওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ইংরেজি শব্দ ‘ফোনি ওয়ার’ যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি পরিস্থিতির বেলায় ব্যবহার করা হয়। প্রথমটি হলো যুদ্ধ চলতে থাকা সময়ে সংঘাতের মাত্রা হ্রাস পাওয়া এবং অন্যটি হচ্ছে আপাতদৃষ্টে শান্তি বিরাজমান থাকার সময়ে ক্রমশ তীব্র হয়ে আসা যুদ্ধপ্রস্তুতি। ইউক্রেন ও তাইওয়ানকে কেন্দ্রে রেখে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন জোটের সামরিক মহড়া চালানো এবং সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি নিজের মিত্রদের অস্ত্রবলে সজ্জিত করায় প্রকাশ্যে চালিয়ে যাওয়া তৎপরতা এই দ্বিতীয় অর্থের ‘ফোনি ওয়ার’কেই মনে করিয়ে দিচ্ছে, যেটা কিনা উচ্চ স্বরে বেজে চলা যুদ্ধের ডঙ্কার আওয়াজকে করে তুলছে আরও অনেক বেশি ভীতিকর।

ইউক্রেন কিংবা তাইওয়ানকে ঘিরে আরও একটি সর্বগ্রাসী যুদ্ধ বিশ্বে শুরু হতে যাচ্ছে কি না এবং সেই যুদ্ধ শুরু হলে কে হবে বিজয়ী আর কে হারিয়ে যাবে পরাজিত শক্তি হিসেবে ইতিহাসের অন্ধকারে, সেই হিসাব সমরবিশারদেরা সমানে করে গেলেও বিশ্বজুড়ে এখন বড়ই আকাল চলছে শান্তিকামী মানুষের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের। কোথাও এখন আর দেখা মিলছে না পিকাসোর মতো প্রত্যয়ী মানুষের, যাঁরা কিনা যুদ্ধবাজদের মুখের ওপর বলে দিতে পারবেন, ‘অনেক হয়েছে, ধ্বংসের আগুনের দিকে সবাইকে ঠেলে দেওয়ার আগে অন্তত এই ছবির দিকে তাকিয়ে এবারে একটু ক্ষান্ত দাও।’ আর এরা নেই বলেই যুদ্ধ এখন যেন হয়ে উঠছে আরও বেশি অবশ্যম্ভাবী; যদিও আমরা সবাই জানি সর্বগ্রাসী যুদ্ধ আবারও শুরু হলে এর ভয়ংকর পরিণতি থেকে নিস্তার পাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না।

  • মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক