ইউক্রেনবাসীর চোখে পুতিনের ধেয়ে আসা

ইউক্রেনের সেনাসদস্যরা দেশটির সাধারণ মানুষকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেনছবি: এএফপি

পর্যবেক্ষকদের কেউ ভাবছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করবেন; কেউ ভাবছেন করবেন না। তবে ইউক্রেনবাসী মনে করছে, পুতিন ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে যখন সেটিকে রাশিয়ার দখলে নিয়েছিলেন, তখনই রাশিয়ার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ লেগে গেছে এবং যুদ্ধটা এখনো জারি আছে।

হাজার হাজার ইউক্রেনীয় ইতিমধ্যেই রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এ কারণে পুতিন এরপরে কী করবেন বা না করবেন তা অনুমান করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে কিয়েভ (ইউক্রেনের রাজধানী) সময় নষ্ট করতে চায় না। বরং আজ কী করতে হবে তার ওপরই তারা দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে।

ইউক্রেনীয় নেতারা বুঝতে পারছেন, তাদের অবশ্যই সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে হবে; যুদ্ধ লাগলে তার যে প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে তা যথাসম্ভব কমানোর পথ বাতলাতে হবে এবং যতটা সম্ভব মিত্র খুঁজে বের করতে হবে। তারা শুধু পশ্চিমাদের সহায়তা পাওয়ার আশায় বসে থাকতে চায় না। তারা অন্যদেরও যে কোনো সহায়তাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করতে চায়।

ইউক্রেনীয়দের যদিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হচ্ছে, তার পরও তারা শান্তির কথা মাথায় রেখেছে। যুদ্ধটি বড় নাকি ছোট হবে, আকাশ পথে নাকি স্থলপথে হবে, শহরে নাকি গ্রামাঞ্চলে হবে তা নিয়ে তারা ভাবছে না। আসলে সেখানকার মাঠপর্যায়ের অবস্থা তাদের যতটা আশাবাদী হওয়াকে অনুমোদন দেয় তারা তার চেয়ে বেশি আশাবাদী অবস্থায় আছে। ইউক্রেনের একজন শীর্ষ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ কয়েক দিন আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘স্লাভমির, আমার তিনটি মেয়ে আছে। সবচেয়ে ছোটটির বয়স এক বছর। আমি কীভাবে আশাবাদী না হয়ে পারি?’

পশ্চিমা মিডিয়া আউটলেটগুলো যে কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে পড়ে শেষ করা অসম্ভব, এমন পরিমাণে ইউক্রেন সংক্রান্ত বিশ্লেষণ, ভবিষ্যদ্বাণী এবং মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছে। সেই সব লেখায় যুদ্ধের অনিবার্যতা এবং অসারতা দুটোই উঠে আসছে।

সেই সব লেখার মূল বক্তব্য হলো, পুতিনকে অবশ্যই আক্রমণ করতে হবে কারণ তিনি তা না করলে তাঁর মুখ হারাবেন। এখন তার দীর্ঘ রাজত্বের শেষ পর্যায়ে এসে এমন একটি উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, যদি তিনি ইউক্রেনকে কবজা না করে ফিরে যান তাহলে তাঁর ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

ইউক্রেনীয়রা এখন পচে যাওয়া একটি শান্তি চেষ্টার চেয়ে যুদ্ধকেই বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছে। তারা কোনোভাবেই পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার আশা করে না; কিন্তু তারা যে অজেয় তা রাশিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।

পুতিন জানেন, যে এটাই তাঁর শেষ ও সেরা সুযোগ। কারণ এই মুহূর্তে চীনকে সামাল দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত আছে যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানির নতুন জোট সরকারের নেতৃস্থানীয় দলটি রাশিয়াপন্থী। ওদিকে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ পুনর্নির্বাচনে জয়ের চেষ্টায় ব্যস্ত আছেন। আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ক্ষমতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। রাশিয়ার গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল ইউরোপ মহামারিতে নিজের গায়ে সৃষ্ট ক্ষতের ব্যথা সারাতে নিজের জিব দিয়ে সেই ক্ষত চাটছে।
পুতিন বুঝতে পারছেন, লোহা গরম থাকতে থাকতেই হাতুড়ি মারতে হবে। তিনি ইতিমধ্যেই ৬২ হাজার কোটি ডলারের এক বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলেছেন যা তাঁকে ডলার-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিয়েছে।

সর্বোপরি, পুতিন বুঝতে পারছেন, তিনি যদি ইউক্রেনের আশপাশে তাঁর জমায়েত করা লাখ খানিক সেনাকে গুটিয়ে নিয়ে আসেন, তাহলে পশ্চিমারা আর রাশিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে না। রাশিয়া পিছু হটলেই ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে তার উপস্থিতি জোরদার করা শুরু করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জন্য যা যা ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে তা বাতিল করে দেবে।

পুতিন জানেন, ইউক্রেন স্পষ্টতই রাশিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোতে যোগ দেবে কি দেবে না, সেটি এখন আর তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় কারণ কার্যত এটি এখন ন্যাটো জোটেরই অংশ হয়ে গেছে। দেশটি ন্যাটোর মান অনুযায়ী তার সামরিক আধুনিকায়ন করছে এবং পশ্চিমাদের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম গ্রহণ করেছে।

ক্রেমলিনের দৃষ্টিতে, ইউক্রেন ইতিমধ্যে শুধু ন্যাটো নয়, ক্রমশ তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যের মতো আচরণ করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেন তার রাষ্ট্রত্বকে আরও সুসংহত করছে, তার নিজস্ব পরিচয়কে সুরক্ষিত করছে এবং ইইউর বৃহত্তম অর্থনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে। এমনকি তারা রাশিয়ার ওরপর তার জ্বালানি নির্ভরতাও একেবারে কমিয়ে ফেলেছে যা কিছুদিন আগে কল্পনাও করা যেত না।

আরও পড়ুন

তবে প্রশ্ন হলো, যুদ্ধে গিয়ে রাশিয়ার লাভটা কী? এই যুদ্ধে এমন কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই যা রাশিয়াকে ইউক্রেনের ওপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ এনে দিতে পারে।

কারণ ইউক্রেনীয়রা এখন পচে যাওয়া একটি শান্তি চেষ্টার চেয়ে যুদ্ধকেই বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছে। তারা কোনোভাবেই পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার আশা করে না; কিন্তু তারা যে অজেয় তা রাশিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।

ছোট বা বড়—যে আকারের যুদ্ধই হোক না কেন, পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া একই হবে। ইউক্রেনের ওপর আরেকটি রুশ আক্রমণ গোটা ইউরোপে অস্থিরতা তৈরি করবে।

এই পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে ইউক্রেনে সাফল্য এখনো সম্ভব কিনা তা ক্রেমলিনের কৌশলবিদদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আট বছরের যুদ্ধ সহ্য করা চার কোটি ইউক্রেনীয় কি সত্যিই দীর্ঘ মেয়াদে ক্রেমলিনের অনুগত হতে বাধ্য হতে পারে? ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটি কি সত্যিই দখল করা যাবে এবং দখল করা গেলে তারপরে দেশটিকে কি শান্ত করা যাবে?

আফগানিস্তানে মার্কিন ব্যর্থতা দেখিয়েছে, যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে শুরু করা অনেক সহজ। রাশিয়ানরা নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানে তাদের নিজস্ব বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেটঅনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

স্লাভমির সিয়েরাকভস্কি জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো