ইউরোজোনের দুর্দশা

জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস

২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকে ইউরোজোন ভালো করছে না, শুধু এ কথা বলা হলে কমই বলা হয়। এমনকি এর সদস্যদেশগুলো জোনের বাইরের ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও খারাপ করছে। এমনকি এই সংকটের কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও জোনের অবস্থা খারাপ। ইউরোজোনের সবচেয়ে দুর্বল দেশগুলো মন্দায় নিমজ্জিত হয়েছে। গ্রিসের কথাই চিন্তা করুন। এই দেশটির অবস্থা তো ১৯৩০-এর দশকের মন্দাকবলিত দেশগুলোর চেয়েও খারাপ। আবার জোনের সদস্যদের মধ্যে জার্মানি সবচেয়ে ভালো করছে। তবে সেটা তুলনামূলক। তারা আসলে প্রতিবেশীদের ক্ষতি করে এগোচ্ছে, যাকে বলে বেগার দাই নেইবার পলিসি। ফলে দেশটির সাবেক সহযোগীদের ক্ষতির বিনিময়ে তার সফলতা আসছে।
এই অবস্থা ব্যাখ্যা করতে চার ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। জার্মানি আবার এই দুর্বল দেশগুলোকে দোষারোপ করে থাকে। তারা মূলত গ্রিসের ঋণ সংকটের দিকে অঙ্গুলি হেলন করে এ কথাটা বলে। কিন্তু এর মাধ্যমে তারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়। কারণ, ইউরো সংকট সৃষ্টি হওয়ার আগে স্পেন ও আয়ারল্যান্ডে উদ্বৃত্ত ছিল। তাদের ঋণ জিডিপির অনুপাতও কম ছিল। অর্থাৎ এই সংকটই ঘাটতি ও ঋণ তৈরি করেছে। ব্যাপারটা এর উল্টো নয়।
জার্মানি ছাড়া আর যারা ‘ভুক্তভোগীকে দোষারোপ’ করে, তারা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও শ্রমবাজারের অতিরিক্ত সুরক্ষার ব্যাপারটিকেই ইউরোজোনের সংকটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ নরওয়ে ও সুইডেন খুবই শক্তিশালী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, যাদের শ্রমবাজার খুবই সুরক্ষিত। এমনকি আজ যেসব দেশের অবস্থা খারাপ, তারা ইউরো প্রবর্তনের আগে ভালোই করছিল, এমনকি ইউরোপের বর্তমান গড় মানের চেয়ে তাদের অবস্থা তখন ভালো ছিল। শ্রম আইনে হঠাৎ পরিবর্তন আনার কারণে তাদের অবস্থা খারাপ হয়েছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। বা আলস্যের কারণেই এটা হয়নি। মুদ্রার ব্যবস্থাপনার কারণে এমনটি হয়েছে।
দ্বিতীয় ধরনের ব্যাখ্যায় একধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, ইশ্ ইউরোপের যদি ভালো নেতৃত্ব থাকত। আর তারা যদি সেই নীতি বাস্তবায়ন করত। ভুল নীতি, অর্থাৎ শুধু কৃচ্ছ্র নয়, ভ্রষ্ট ও তথাকথিত কাঠামোগত সংস্কারের কারণে অসমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি এসব দেশের চাহিদা ও প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে।
তৃতীয় ঘরানায় আছেন ডানপন্থী ঘরানার ইইউ সমালোচক আমলারা, যাঁরা অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরতে ও নবরীতি প্রতিকূল বিধিবিধান করতে চান। মানুষের জীবনমান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই সমালোচকেরা বলেন, যাঁরা স্বীকার করতে চান না, পশ্চিমের মানুষেরা ভালো আছেন বা এখানকার পানি ও বায়ু দূষণমুক্ত, তাঁদের বেইজিং সফর করা উচিত।
চতুর্থ ঘরানার সমালোচকেরা বলেন, আসল দোষ ইউরোর, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নীতি ও কাঠামোর নয়। জন্মের সময় থেকেই ইউরোতে ভুলভ্রান্তি ছিল। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে ভালো নীতিপ্রণেতারাও এটা কার্যকর করতে পারতেন না। স্বর্ণ মানে যে রকম কঠোরতা থাকে, ইউরোজোনের কাঠামো সে রকম কঠোরতা আরোপ করেছিল। একক মুদ্রা ব্যবস্থার কারণে এই দেশগুলো সমন্বয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার পায়নি, অর্থাৎ বিনিময় হার। আর ইউরোজোন মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির পরিসর ছোট করে ফেলেছে।
এ রকম অপ্রতিসম আঘাত ও উৎপাদনশীলতার ভিন্নতার কারণে প্রকৃত বিনিময় হারে সমন্বয় আনা জরুরি। অর্থাৎ ইউরোজোনের পণ্যমূল্য জার্মানি ও উত্তর ইউরোপের তুলনায় কম হওয়া উচিত। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে জার্মানি নাছোড়বান্দা হওয়ায় অন্যান্য স্থানের মূল্যহ্রাসের রাশ টেনে ধরে এটা অর্জন করা সম্ভব। প্রথাগতভাবে এর মানে দাঁড়ায় বেদনাদায়ক বেকারত্ব ও ইউনিয়নের শক্তি হ্রাস। এই সমন্বয়ের বেদনাটা ভোগ করতে হয় ইউরোজোনের দুর্বল দেশগুলো ও তাদের শ্রমিকদের। ফলে ইউরোজোনের দেশগুলোকে এক ধারায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পরিণামে একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের ও প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য বাড়ছে।
এই ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতি এই ব্যর্থতা নিশ্চিত করে। শুধু ইউরোজোনের বিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন ঘটানোর মধ্য দিয়ে ইউরোকে কার্যকর করা সম্ভব। এর জন্য সাতটি পরিবর্তন আনতে হবে: ১. একমুখীকরণের মানদণ্ড পরিত্যাগ করতে হবে, যার জন্য ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশের কম হওয়া উচিত ২. কৃচ্ছ্রর জায়গায় প্রবৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যার জন্য লাগবে সংহতি ও তহবিল ৩. দেশগুলোকে অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীনে মুদ্রা ধার করতে হয়ে—এমন সংকটপ্রবণ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে হবে। এর বদলে ইউরো বন্ড বা অনুরূপ ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে ৪. সমন্বয়ের সময় ভার ছড়িয়ে দেওয়ার উন্নততর ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। যেসব দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে, সেসব দেশকে মজুরি বৃদ্ধি ও রাজস্ব ব্যয় বাড়ানোর অঙ্গীকার করতে হবে। এতে সেখানে পণ্যমূল্য বাড়বে, হিসাবে ঘাটতি থাকা দেশগুলোর তুলনায়। ৫. ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে হবে, যারা শুধু মূল্যস্ফীতি দেখভাল করে। অথচ মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার দিকেও নজর দেয় ৬. অভিন্ন স্থিতির বিমা গড়ে তুলতে হবে, যাতে অর্থ অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থায় থাকা দেশগুলো থেকে পাচার না হয় ৭. এমন শিল্পনীতি করতে উৎসাহিত করা, যাতে ইউরোজোনের পিছিয়ে পড়া দেশগুলো নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে।
এই পরিবর্তনগুলো তেমন বড় কিছু নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউনিয়নের নেতাদের হয়তো এসব বাস্তবায়ন করার রাজনৈতিক ইচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। যে ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল সমৃদ্ধি বয়ে আনা, সে এখন উল্টো ফল দিতে শুরু করেছে। ফলে এই অচলাবস্থার চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ বিচ্ছেদ হওয়াটাই ভালো হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।