ইছামতী কি ফিরে পাবে পুরোনো প্রাণ

পাবনা শহরে ইছামতী নদী। কোথাও ক্ষীণকায়, কোথাও স্বাস্থ্যবান।ছবি: প্রথম আলো

সারা দেশে মোট ১২টি স্বতন্ত্র ইছামতী নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন যে ইছামতীর কথা বলছি, সেটি পাবনা শহরের ভাড়ারায় পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে পাবনার বেড়া উপজেলায় হুরাসাগর নদে মিলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ নদীপথে কখনো বজরা, কখনো স্টিমারে বহুবার চলাচল করেছেন। ইছামতীকে তিনি ‘মানুষঘেঁষা নদী’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর ছিন্নপত্রাবলীতে এ নদীর কথা বহুবার এসেছে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ থেকে তিনি যখন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কিংবা নওগাঁর পতিসরে জমিদারি দেখতে যেতেন, তখনো পদ্মা থেকে ইছামতী নদী ধরেই যেতেন। এ নদীর অনেক স্থানে ঘাট ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরা ভিড়ত ঘাটে। এ নদীর একটি স্থানের নাম লঞ্চঘাট। পাবনা শহরের ভাটিতে এখনো এ নদী প্রস্থে ২০০ থেকে ৩০০ মিটার হবে।

পাবনার প্রাকৃতিক আশীর্বাদ ইছামতী নদী। ৪০ বছর ধরে নদীটির ওপর সীমাহীন নির্যাতন হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌপথগুলোর অবস্থা দেখতে কয়েক দিনের জন্য নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌপথের কোনো নদীই ভালো নেই। ইছামতী নদীর অবস্থা দেখলাম ভয়াবহ।

ইছামতী নদীকে প্রধানত মেরে ফেলেছে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিরাও কম সর্বনাশ করেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আশির দশকে একটি স্লুইসগেট দিয়ে এ নদীর পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করেছে। সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান এ নদীর ওপর সেতুবিহীন আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া আছে দখল ও দূষণ। পানিতে নামা যায় না, মাছ মারা যায়, দুর্গন্ধও অনেক। ইটভাটাও আছে নদীর ভেতরেই।

পাবনার প্রাকৃতিক আশীর্বাদ ইছামতী নদী। ৪০ বছর ধরে নদীটির ওপর সীমাহীন নির্যাতন হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌপথগুলোর অবস্থা দেখতে কয়েক দিনের জন্য নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌপথের কোনো নদীই ভালো নেই। ইছামতী নদীর অবস্থা দেখলাম ভয়াবহ।

আরও পড়ুন

পাবনা শহরের চর শিবরামপুর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করেছে। এই স্লুইসগেটের কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদীর চূড়ান্ত সর্বনাশ পানি উন্নয়ন বোর্ড হরহামেশাই করে থাকে। এখানেও একই ঘটনা ঘটেছে।

ইছামতীর উৎসস্থল থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনা শহরের অনন্ত বাজার। সেখানে আড়াআড়িভাবে সেতু ছাড়া নির্মাণ করা সড়কটি ওই অংশের নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ইছামতী একটি শাখা হিসেবে প্রবাহিত হওয়ার সামান্য কিছু দূর পর প্রায় এক কিলোমিটার দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়ে আবারও একটি ধারায় মিলিত হয়েছিল। কিন্তু এ দুটি ধারার একটি ধারা প্রায় সম্পূর্ণ দখল হয়ে গেছে। পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো যে ধারাটি, সেটি এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। কোথাও ভরাট, আবার কোথাও সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো একটু-আধটু টিকে আছে।

এ নদীর ওপর পাবনা শহরেই ১৭টি সেতু আছে। সব কটি সেতুই নদীর চেয়ে অনেক ছোট। এই ছোট সেতুগুলোও নদীটির পানি দীর্ঘদিন ধরে বাধাগ্রস্ত করেছে। পাবনা শহরে নদীটির খনন সরেজমিন দেখলাম। যেহেতু খনন চলমান, তাই খনন যথাযথ হচ্ছে কি না, বলা যাবে না। তবে পাউবোর নদী খনন দেখে আশঙ্কা থেকে যায়। তারা কি আদৌ সিএস নকশা আমলে নেবে? কোথাও কোথাও তারা সীমানাখুঁটিও দিয়েছে। কিন্তু খনন করছে সীমানাখুঁটির অনেক ভেতরে। শহরের কাচারিপাড়ায় সিএস নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না মর্মে স্থানীয় ব্যক্তিরা অভিযোগ করছেন। প্রভাবশালীদের ছাড় দেওয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন

ইছামতী নদীতে প্রচুর দখল আছে। গোবিন্দা নামক স্থানে একটি বাড়ির গায়ে লাল কালিতে ইছামতীর সীমানা চিহ্নিত করে লেখা দেখলাম ‘নদী’। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এ নদী সুরক্ষায় সচেষ্ট আছে। কিছু কিছু অবৈধ দখল উচ্ছেদ হয়েছে। সম্প্রতি সেখানে অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম আবারও শুরু হয়েছে।

এ নদীটিকে বাঁচাতে হলে অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু খনন আর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করলেই নদী রক্ষা হবে না। যেখানে স্লুইসগেট করা হয়েছে, তার দৈর্ঘ্য মাত্র তিন থেকে চার মিটার। নদীর তুলনায় এ স্লুইসগেট খুবই ছোট। এটি ভেঙে দিতে হবে। আড়াআড়ি সড়ক ভেঙে দিয়ে সেখানে বড় করে সেতু স্থাপন করতে হবে। সব ছোট সেতু ভেঙে দিয়ে বড় সেতু স্থাপন করতে হবে। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। নদীকে ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়ার কাজ জড়িত এবং সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও দৃষ্টান্তমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ইছামতী’ শিরোনামে একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘যখন রব না আমি, রবে না এ গান,/ তখনো ধরার বক্ষে সঞ্চরিয়া প্রাণ,/ তোমার আনন্দগাথা এ বঙ্গে, পার্বতী,/ বর্ষে বর্ষে বাজিবেক অয়ি ইছামতী!’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ নদীকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন। নিজের মধ্যে এ নদীর যে ভবিষ্যৎ দৃশ্যকল্প তৈরি হয়েছিল, তার লেশমাত্র নেই। পাবনাবাসীর গণমানুষের দাবি এ নদীকে ফেরানো হোক আগের রূপে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

[email protected]

আরও পড়ুন