ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এক নতুন ‘গ্রেট গেম’

উনিশ শতকের বেশির ভাগ সময়ে ভারতের ব্রিটিশ রাজ তৎকালীন জারশাসিত রাশিয়ার মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্য ও পরিধি নিয়ে ভয়ে থাকত। ওই সময়ে ব্রিটিশ রাজের ধারণা ছিল রাশিয়ার দক্ষিণমুখী অভিযানের লক্ষ্যবস্তু আফগানিস্তান এবং পরবর্তীকালে ভারত পর্যন্ত তা সম্প্রসারিত হতে পারে বলে আশঙ্কার মধ্যে ছিল। ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ থেকে সমরবিদেরা তখন মনে করলেন এই সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলার পথ হচ্ছে আফগানিস্তানকে হয় ব্রিটিশ প্রভাবে নিয়ে আসা অথবা আফগানিস্তানকে নিরপেক্ষ ওই সময়কার এই দুই বড় রাজকীয় শক্তির মধ্যে বাফার স্টেট হিসেবে কায়েম করা। এই বাফার স্টেটে তৎকালীন ইরানের এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কিছু অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশ রাজের এ উদ্যোগ ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট গেম’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ব্রিটিশদের এ প্রয়াস শুরু হয়েছিল ১৮৩০ ও ১৮৩৮ সালে। সে সময়ে ব্রিটিশ রাজ আফগানিস্তান আক্রমণ করে, যাতে সেখানে ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন রাখা যায়। তবে ঐতিহাসিক গবেষকেরা এখন বলছেন যে ব্রিটিশ-রাশিয়া যৌথভাবে আমুদরিয়াকে আফগানিস্তান-রাশিয়ার বর্ডার হিসেবে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করেছিল। রাশিয়া পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সীমানা লঙ্ঘন করেনি। কিন্তু এর প্রায় দেড় শ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে প্রবেশ করার পর ব্রিটিশ বাহিনীর পরিবর্তে আমেরিকার সঙ্গে শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর গ্রেট গেম। সোভিয়েতদের পতনের পর মধ্য এশিয়ার গ্রেট গেম শেষ হয়েছিল।

অনেকেই মনে করেছিলেন যে ভারতবর্ষের বিভাজন, স্বাধীনতা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর একক বিশ্বে দ্য গ্রেট গেম তত্ত্বের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হবে না। অবশ্য ভূরাজনীতি ও ভূকৌশল নিয়ে যঁারা গবেষণা করেন, তাঁরা হয়তো আমার সঙ্গে একমত যে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া তথা এশিয়া অঞ্চলে যে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, যেখানে দক্ষিণ-এশিয়া অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একবিংশ শতাব্দীতে নতুনভাবে শুরু হয়েছে পুরোনো গ্রেট গেম। এই গ্রেট গেমের এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত, অপর প্রান্তে চীন এবং এই দুই শক্তির রশি–টানাটানির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও তৎসংলগ্ন দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। কথিত এই শক্তির মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা হচ্ছে এই দুই দেশকে জোটে টানতে।

বর্তমানে বাংলাদেশ এই নতুন গ্রেট গেমের অন্যতম ভূকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। বর্তমানে ভারত মহাসাগরতীরের সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এ অঞ্চলে গঠিত চীনবিরোধী শক্তির প্রথম সারির দেশ। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে পুরোনো এশিয়া-প্যাসিফিক বহুমাত্রিক জোটের বদলে ইন্দো-প্যাসিফিক জোট তৈরি করার প্রথম ধাপ পার করেছে। স্বভাবতই এই জোট গড়ে উঠেছে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর মুখোমুখি অবস্থানের প্রেক্ষাপটে। বর্তমানে এই জোটের যে চার শক্তির কথা বলা হয়, তার মধ্যে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পরই বৃহৎ সামরিক শক্তি, তবে চীনের তুলনায় অনেকখানি দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রই প্রধান শক্তি আর সঙ্গে রয়েছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।

কয়েক মাস ধরে এই চার শক্তির, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যথেষ্ট উত্তেজনাকর পর্যায়ে রয়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত বৃহৎ নৌবাহিনীর অধিকারী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া সম্পূর্ণ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার ও দাপিয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। চীনের এখন লক্ষ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে সংযুক্ত করা এবং কৌশলগত কারণে ভারতকে চাপের মধ্যে রাখা। এরই অংশ হিসেবে চীন লাদাখ ও অরুণাচল অঞ্চলে শক্তি বৃদ্ধি এবং লাদাখ অঞ্চলে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার (ভারতীয় ভাষ্যকারদের মতে) দখলে রেখেছে। সিকিম-অরুণাচল সীমান্তেও চীনা বাহিনী যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর মিলছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত সামরিক বাজেটের পরিধি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এরপরও ভূকৌশলগত দিক থেকে ভারত চীন থেকে বহু পেছনে। ভারত বর্তমানে সামরিক খাতে খরচের দিক থেকে বিশ্বে তৃতীয় দেশ। এরপরও দ্বিতীয় বৃহৎ খরুচে দেশ চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। জেমস ইন্টেলিজেন্সের মতে যেখানে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ২৬১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারতের ৭১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।

শুধু প্রতিরক্ষা বাজেট বা অর্থ খরচের বিষয়টিই নয়, ভারতের সামরিক বাহিনীর আধুনিক সমরাস্ত্র ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সেনাবাহিনীর জন্য ১৮ হাজার ফুট উঁচু লাদাখ অঞ্চলের জন্য প্রায় ৭০ হাজার বিশেষ রাইফেল কিনতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে বিরোধের কারণ ভারত সরকার কর্তৃক দেশটির সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা ও লাদাখকে আলাদা করা। চীনের দাবি, লাদাখ তিব্বতের অংশ, যা কখনোই ভারতের ছিল না। একইভাবে অরুণাচল প্রদেশ, যার পূর্ব নাম ছিল নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স (এনইএফএ)। চীন ১৯৫৯ সালের নকশা ও দাবিতে অটল রয়েছে। চীনের এ আগ্রাসী মনোভাবের আরেক কারণ চীন সাগর এবং ভারত মহাসাগরে চীনের বিরুদ্ধে বিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের গাঁটছড়া বাঁধা।

লাদাখকে কেন্দ্র করে চীন-ভারতের শক্তি প্রদর্শন সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ভূরাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে ফেলেছে। বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ছাড়া এমনকি ভুটানও চীনের বলয়ে রয়েছে। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে চীনের বলয়ের মধ্যে আনতে যথেষ্ট তৎপর। বাংলাদেশ এই দুই শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চললেও পক্ষে টানার দৃশ্যমান প্রয়াস ভারতের এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমান। ভারতের প্রচেষ্টার পর এখন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে টানার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ এখন এই নতুন ‘গ্রেট গেম’–এর অন্যতম ক্ষেত্র। দুই দেশই বাংলাদেশে চীনের প্রভাব খর্ব করতে সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। তবে চীন এখন বিশ্বের প্রায় শীর্ষ ধনী দেশ এবং বাংলাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চীন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দুর্বল।

অপর দিকে দুই দেশই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ‘মুলা’ ঝোলাচ্ছে। ভারত মুখে সমাধানের কথা বললেও মিয়ানমারকে চীনের বলয় থেকে কিছুটা দূরে টানতে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে। সম্প্রতি ভারত প্রায় ৩৬ বছরের পুরোনো সোভিয়েত নির্মিত সাবমেরিন ভারতীয় শিপইয়ার্ডে সংস্কার করে মিয়ানমার নৌবাহিনীকে দিয়েছে। এর পেছনের কারণ হলো বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে চীনের সাবমেরিনের সংযোজন এবং নেভিতে চীনের প্রভাবের বিপরীতে মিয়ানমারে ভারতের প্রভাব বাড়ানো। শুধু সাবমেরিনই নয়, রাশিয়ার তৈরি টি-৭২ ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামও মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ভারত। তবে ভারত মিয়ানমারকে চীনের বলয় থেকে সরিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক মনোভাবাপন্ন করতে পারবে কি না, তা এখনো বলার সময় আসেনি। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেবে কি না, তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের কথা নতুন করে বলার কিছুই নেই। ভূকৌশলগত কারণে উভয় দেশ পরস্পরের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও বহুবিধ কারণে সম্পর্ক শীতল না হলেও তেমন উষ্ণ নেই। ভারতের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে নানা ধরনের দ্বিপক্ষীয় তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো পক্ষই গ্রহণ করেনি। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইদানীংকার তৎপরতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি প্রস্তাব রেখেছে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যুক্ত হতে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এই নতুন গ্রেট গেমে জড়িত হতে চাইছে না এবং বাংলাদেশের জন্য এটাই উত্তম।

বাংলাদেশ কোনো পক্ষে যাওয়ার অবস্থানেই নেই। আমাদের মতো দেশের কোনোভাবেই সামরিক প্রতিযোগিতার বলয়ে ঢুকে পড়া ঠিক হবে না। এতে বাংলাদেশর উন্নয়নের পথ ব্যাহত হবে। বৃহত্তর ভূকৌশলগত খেলায় খেলোয়াড় হওয়ার অভিপ্রায় বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যত নিশ্চয়তাই দিক, ইন্দো-প্যাসিফিক ফোরামের অন্যান্য উপকারিতার যত অঙ্গীকারই থাকুক, এটা যে চীনবিরোধী যুক্তরাষ্ট্র-ভারতকেন্দ্রিক একধরনের সামরিক জোট, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]