ইমরানের বিরুদ্ধ শক্তির নেপথ্যে কারা?

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

পাকিস্তান সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে আতিথ্য দিয়েছিলেন, সে কথা সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান ভোলেননি। সেই আতিথেয়তার প্রতিদানে ইমরানের জন্য মোহাম্মাদ বিন সালমান এবার কাবা শরিফের দরজা খুলে দিয়েছেন। একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্মান দেখানোর অংশ হিসেবে সৌদি সরকার সাধারণত কাবাঘরের দরজা খুলে দেয়। শুধু কাবাঘরে ঢুকতে দেওয়াই নয়, যখন সৌদি কর্তৃপক্ষ জানল যে ইমরান খান এবং তাঁর সঙ্গে আসা ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান, তখন ক্রাউন প্রিন্স তাঁদের কমার্শিয়াল ফ্লাইটে না পাঠিয়ে নিজের ব্যবহার্য বিমানে পাঠিয়েছেন।

বহু বছর ধরেই পাকিস্তানের শাসকেরা সৌদি সরকারের আদর–আপ্যায়ন পেয়ে থাকেন। প্রায় দুই দশক আগে তৎকালীন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অপহরণ, ছিনতাই ও দুর্নীতির অভিযোগে পাকিস্তানের আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে তিনি ২০০০ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে আট্টক ফোর্টের কয়েদখানা থেকে মুক্ত হন। এরপরই সৌদি রাজকীয় পরিবারের প্রাইভেট জেটে চড়ে সপরিবার তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমান। মক্কায় পৌঁছেই নওয়াজ ও তাঁর পরিবার ওমরাহ পালন করে সৌদি সরকারের জন্য বিশেষ দোয়া করেছিলেন।

২০০৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সৌদি আরব সফর করেন। ওই সময় মোশাররফের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন শেখ রশিদ, যিনি বর্তমানে ইমরান খানের সরকারের রেলমন্ত্রী হিসেবে আছেন। এই শেখ রশিদের ভাষ্যমতে, ২০০৪ সালের সফরের সময় মোশাররফকে নিয়ে তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ একান্ত বৈঠক করেছিলেন। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, ইরাক ও আফগানিস্তান নিয়ে তাঁরা কথা বলেছিলেন। রশিদ খানের ভাষায়, ‘প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফই পাকিস্তানের প্রথম নেতা, ওমরাহ শেষে যাঁকে কাবাঘরের ছাদে উঠতে দেওয়া হয়েছিল।’

২০০৬ সালে মোশাররফ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পাকিস্তান ছাড়ার পর সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যাওয়ার পর বাদশাহ আবদুল্লাহ জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কোথায় বসবাস করতে চান। মোশাররফ ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাদশাহ আবদুল্লাহ তাঁকে ছোট ভাইয়ের মতো জানতেন এবং বাদশাহ নিজে উদ্যোগী হয়ে লন্ডনে মোশাররফের নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে প্রচুর টাকা জমা করে দেন।

অতি সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান রাহিল শরিফকেও সৌদিরা দারুণ আকর্ষণীয় একটি উপহার দিয়েছে। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে সৌদির নেতৃত্বাধীন ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম কোয়ালিশনের কমান্ডার-ইন-চিফ পদে বসানো হয়েছে। কয়েক দিন আগে সৌদির আবকাইক এবং খুরাইস তেলক্ষেত্রে যে হামলা হয়েছে, সে বিষয়ে নিজের অধস্তনদের তিনি কী ব্যাখ্যা দেবেন, সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক নিচ দিয়ে উড়ে আসা ড্রোনকে প্রতিহত করার মতো প্রযুক্তি সৌদির কাছে নেই। এ কারণে এ হামলা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। গার্ডিয়ান পত্রিকা অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা বলেছে, ‘সৌদি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভুল দিকে তাক করা ছিল, সেটা তাক করা ছিল উপসাগরীয় ইরান এবং দক্ষিণের ইয়েমেনের দিকে।’

ব্যাখ্যা যা-ই হোক, রাহিল শরিফকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কারণ, এই পদ একেবারেই আলংকারিক। শুধু পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান হিসেবে খাতির করে তাঁকে এই পদ দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার জন্য দেশটির রাজনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের বিশেষ সুবিধা ও ‘স্নেহের চোখে’ দেখা সৌদি আরবের বহুদিনের রেওয়াজ। সেই রেওয়াজের অংশ হিসেবেই ইমরান খানকে সৌদি সরকার বিশেষ সমাদর করছে। তবে সেই সমাদর কত দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

দ্বিতীয়বারের মতো জেলে যাওয়া নওয়াজ শরিফের সমর্থকেরা সংগঠিত হয়ে উঠছেন। সেনাবাহিনীর একটি অংশ ইমরানবিরোধী অবস্থানে যাচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, সৌদি কর্তৃপক্ষ গোপনে গোপনে নওয়াজ শরিফকে আবার মুক্ত করার জন্য কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সহজে নওয়াজকে জেল থেকে বের হতে দেবেন না বলে একরকম শপথ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আগের রেকর্ড বলছে, নিজের শপথ ভাঙতে তাঁর বেশি সময় লাগে না।

পাকিস্তানে ইমরানবিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে এবং নওয়াজের প্রতি সাধারণ মানুষের সমবেদনা বাড়ছে। এই ইমরানবিরোধিতার পেছনে সেনাবাহিনীর একটি অংশের হাত আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আর সেনাবাহিনীর সেই অংশের পেছনে আছে সৌদি আরব। সে কারণেই ইমরানকে সৌদি আরব সমাদর করলেও তাঁকে তারা সত্যিকার অর্থে কতটুকু সমর্থন করছে, তা ভেবে দেখার বিষয়।

ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
এফ এস আইজাজুদ্দিন: পাকিস্তানের রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক