ইরান কেন সুপ্ত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠল

ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সম্পন্ন করতে আলোচনায় বসেছে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো
ছবি : এএফপি

২০১৫ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ইরান পারমাণবিক চুক্তির সমস্ত প্রেক্ষাপট আবার ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছে, ইসরায়েল দিচ্ছে যুদ্ধের হুমকি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আহ্বান জানাচ্ছে, আর আরব বিশ্ব চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে ইরান কারও কথায় কর্ণপাত করছে না, তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর আস্থাভাজন ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বাজে নীতি ইরানকে সুপ্ত পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইরান পারমাণবিক চুক্তিকে ‘পরমাণু বোমা’ মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বারবার এই চুক্তিকে ‘পচা’ আর ‘বিধ্বংসী’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ২০১৮ সালে কোনো বাস্তব অভিযোগ ছাড়াই চুক্তিটি বাতিল করে দেন। এরপর পরিস্থিতিকে তিনি আরও খারাপ করে তোলেন ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করলে সেই দেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেন। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সবচেয়ে সম্মানিত জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার আদেশও দেন।

চারদিক থেকে আসা এ চাপে ইরান একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে দেশটি তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নতুন করে চালু করে। অস্ত্র উৎপাদন করা যায়, এমন মাত্রার কাছাকাছি নিয়ে যায় এ কর্মসূচিকে। গত জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ইরান প্রশ্নে তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টের নীতি থেকে সরে আসার যে ছোট জানালাটা খোলা ছিল, সেই সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন তিনি। গত ছয় মাসে ইরান পারমাণবিক চুক্তি আবার চালু করতে পারেননি বাইডেন। ট্রাম্প আমলে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তেহরানকে দেওয়া তাঁর নতুন শর্ত বরং উল্টো ফল দিয়েছে।

গত আগস্ট মাসে ইরানের কট্টরপন্থী এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শিষ্য ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এখন তেহরান পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার জন্য উল্টো শর্ত দিচ্ছে। শুধু পারমাণবিক বিষয়ে নয়, ২০১৭ সালের পর আরোপ করা সমস্ত শর্ত তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা। ইরান এখন ওয়াশিংটনের কাছে নিশ্চয়তা চাইছে, চুক্তিতে এমন শর্ত থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র যেন চুক্তি থেকে সরে যেতে না পারে। চুক্তির প্রক্রিয়া আবার চালু করার আগে সব নিষেধাজ্ঞা পরিপূর্ণভাবে এবং সত্যি সত্যি তুলে নেওয়া হয়েছে, সেটার প্রমাণ তারা দেখতে চায়। ইরানের আঞ্চলিক ভূমিকা এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে কোনো আলোচনা তোলা হোক, তারা সেটা চায় না।

সংক্ষেপে বলা যায়, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল এতটা পুরু হয়েছে এবং প্রত্যাশা এত আকাশ ছুঁয়েছে যে ২০১৫ সালের চুক্তিতে ফিরে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব। এ কারণে বাইডেন প্রশাসন তথাকথিত দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে। তারা ইরানের বিরুদ্ধে শক্ত কূটনৈতিক চাপ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার কথা ভাবছে। কিন্তু এই নীতি আগে বহুবার প্রয়োগ করার চেষ্টা হয়েছে এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে পরমাণুবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরান যেন আগের অবস্থায় ফিরে যায়। উচ্চতর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেন্টিফিউজ তৈরি থেকে সরে আসে। অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা তখনই তারা ওঠাবে, যখন ইরান ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা’ বিনষ্টের আচরণ থেকে সরে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি সমন্বিত ও স্থায়িত্ব চুক্তি করতে চাইছে, যাতে ইরান কখনোই আর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে।

সংক্ষেপে বলা যায়, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল এতটা পুরু হয়েছে এবং প্রত্যাশা এত আকাশ ছুঁয়েছে যে ২০১৫ সালের চুক্তিতে ফিরে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব। এ কারণে বাইডেন প্রশাসন তথাকথিত দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে। তারা ইরানের বিরুদ্ধে শক্ত কূটনৈতিক চাপ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার কথা ভাবছে। কিন্তু এই নীতি আগে বহুবার প্রয়োগ করার চেষ্টা হয়েছে এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থ নীতি আবার এখন ব্যবহারের কারণ কী থাকতে পারে? ইরানের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সেটার প্রতিক্রিয়ায় তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি আরও এগিয়ে নেবে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি খুব সতর্কতার সঙ্গে তাদের নীতি প্রয়োগ না করে, তবে তারা একা হয়ে পড়বে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন চাপ প্রয়োগের কাজে রাশিয়া ও চীন অংশ নেবে না। বাস্তব পরিণতি কী হবে, সেটা আগে থেকে না বুঝে ইউরোপীয় ইউনিয়নও এতে যোগ দেবে না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সতর্ক করেছে এই বলে যে, ‘তাদের হাতে সব বিকল্প খোলা আছে’। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষেত্রে একই বক্তব্য আমরা শুনেছিলাম, সেটা উল্টো কী করে উল্টে গেল, সেটাও দেখেছি। ইউক্রেন, তাইওয়ান, ভেনেজুয়েলা, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও এ ধরনের তর্জন-গর্জন আমরা শুনেছি।

কেউ কেউ মনে করছেন, বাইডেন প্রশাসন এখন সরাসরি না এসে ইসরায়েলের মাধ্যমে যুদ্ধ বাধানোর বিকল্প কৌশল খুঁজছে। ইরানের পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে যদি পারমাণবিক শক্তিধর ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করে, তবে সেটা সর্বব্যাপী আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হবে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজে সিদ্ধান্ত এবং মিথ্যে ছুতোয় বাধানো যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে। কিন্তু আমরা যে আবার একটা ভয়ানক যুদ্ধের কাছাকাছি, সেটা বলা যাবে না। ওয়াশিংটন কিংবা তেহরান—কারও দিক থেকেই সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কথা নয়। ইরাক যুদ্ধের বাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাইডেন কৌশল নিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে কম জড়াতে।

আবার তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়ানোর বিষয়ে সতর্ক খামেনি। তিনি ভালো করেই জানেন, এ ধরনের যুদ্ধ ইরানকে একেবারে পঙ্গু করে দেবে। তাঁর নিজের ও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র একটা কূটনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টায় লেগে আছে। তবে ২০১৫ সালের ভিয়েনা চুক্তি আর ২০২১ সালে যদি আবার চুক্তি হয়—দুটো প্রেক্ষাপটে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইরান এখন সুপ্ত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক