ইরানের সঙ্গে যে চুক্তি ১০ বছর আগেই সম্ভব ছিল

যেখানে পুরোপুরি প্রশংসা দেওয়ার দাবি রাখে, সেখানে তা দিতেই হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার লক্ষ্যে দেশটির সঙ্গে চুক্তি করতে নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলেন। আর যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিনিধিদের নিয়ে তাঁরা সেটা করতে সফল হয়েছেন।
ইসরায়েল, ইরানের আঞ্চলিক প্রতিযোগী ও যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীদের বিরোধিতার মুখে স্বাক্ষরিত এই ঐতিহাসিক চুক্তির প্রধান শর্ত হচ্ছে, ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে হবে, যাতে সে তার বেসামরিক সক্ষমতাকে দ্রুততার সঙ্গে সশস্ত্র রূপ দিতে না পারে। এখন ইরানের পারমাণবিক ক্ষেত্রগুলো মনিটর ও তদন্ত করা যাবে, এর বিনিময়ে ইরানের ওপর অনেক বছর আগে যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলো তুলে নেওয়া হবে।
পারমাণবিক যুগে এটা এক মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই ১৯৪৫ সাল থেকে পারমাণবিক শক্তির বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের কারণে রাজনৈতিক নেতারা এর রাশ টেনে ধরার পথ খুঁজছেন। হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞের কয়েক দিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানসহ কানাডা ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীরা পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধের প্রথম পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। এতে বলা হয়েছিল, সব পারমাণবিক অস্ত্র বর্জন করা হবে, আর জাতিসংঘের একটি সংস্থা শান্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পারমাণবিক প্রযুক্তির দেখভাল করবে। ট্রুম্যানের এই উদ্যোগ পরবর্তীকালে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল, আজ আমরা অস্ত্র বিস্তারের বিষয়ে যেসব কথা বলি, তার অধিকাংশই সেই উদ্যোগের মধ্যে ছিল।
কিন্তু সে সময় জোসেফ স্তালিন তাতে রাজি না হওয়ায় পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আর ১৯৬০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সতর্ক করে বলেন, সেই দশকের মধ্যভাগে দুনিয়ার ১৫, ২০ বা ২৫টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রধর হয়ে উঠবে। কেনেডি ১৯৬৩ সালে বলেছিলেন, ‘এতগুলো দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে কী হবে একবার ভাবুন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট, বড়, স্থিতিশীল, অস্থিতিশীল, দায়িত্বশীল, দায়িত্বজ্ঞানহীন সব দেশের হাতে তা থাকলে কী হবে।’
দুটি কারণে পারমাণবিক অস্ত্রের অপরিণামদর্শী ও দুঃস্বপ্নসম বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়েছে। প্রথমত, পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর সক্ষমতা আছে—এমন কয়েকটি দেশ বুঝতে পেরেছিল, এটা করলে তাদের নিরাপত্তা বাড়বে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা পারমাণবিক কর্মসূচি শুরুও করে দিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ এ পথ মাড়িয়েছে, তাদের কৃতিত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র-সংকটের পর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) অভিভাবকত্বে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি—এনপিটি) হয়, যে কারণে অনেক দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চাইলেও তা করতে পারেনি।

>এই চুক্তির বদৌলতে পশ্চিম এশিয়ায় চলমান সহিংসতার রাশ টেনে ধরার লক্ষ্যে বৃহত্তর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ

এনপিটি ১৯৬৮ সালে কার্যকর হয়, তখন থেকেই এই সংস্থাটি পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তারে রাশ টানছে। এখন পর্যন্ত আদি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়া ছাড়া কেবল চীন, ইসরায়েল, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
এই ব্যবস্থার অখণ্ডতা রক্ষায় ইরানের এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই, এই বিপদও ছিল যে ইরান বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি থেকে পরমাণু অস্ত্র বানানোর দিকে অগ্রসর হবে। এর ফলে এই অঞ্চলের অন্য দেশ, যেমন সৌদি আরব অনিবার্যভাবেই সেদিকে অগ্রসর হতো, তার সঙ্গে আরও অনেকেই পরবর্তীকালে যুক্ত হতো।
এই যে ইরানের সঙ্গে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চলল, সেখান থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া সম্ভব। ২০০৩-০৫ সাল পর্যন্ত ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দেশটির প্রধান পরমাণু-বিষয়ক আলোচনাকারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন পণ্ডিত ও উদার মানুষ মোহাম্মদ খাতামি, তাঁর সঙ্গে আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একবার বাণিজ্য ও সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু পরমাণুর বিষয়ে মতৈক্য না হওয়ার সে আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। খাতামি যে পশ্চিমের সঙ্গে আলোচনা শুরুর চেষ্টা করেছেন, তা জর্জ ডব্লিউ বুশের ওয়াশিংটনের পাথুরে জমিতে এসে থমকে যায়। আর পরিণামস্বরূপ জনপ্রিয় ও কট্টরপন্থী মোহাম্মদ আহমাদিনেজাদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু রুহানি যখন পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের আলোচনা করছিলেন, তখন ইরান তিনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশকে প্রস্তাব দিয়েছিল, যার বদৌলতে তারা এক যৌক্তিক সমঝোতার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করেছিল। সেটা হলো, ইরান শুধু বেসামরিক পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করবে, সামরিক নয়। এর ফলে সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা কমে যেত, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও এমন পর্যায়ে থাকত, যাতে অস্ত্র বানানো সম্ভব হতো না; আর সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে ঝুঁকিহীন পারমাণবিক জ্বালানিতে পরিণত করা যেত।
সে সময় আইএইএতে নিযুক্ত ব্রিটিশ প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত পিটার জেনকিন্স জনসমক্ষে বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনাকারীরা ইরানের প্রস্তাবে অভিভূত হয়েছিল। কিন্তু বুশ প্রশাসন যুক্তরাজ্যকে তখন চাপ দিয়ে এমন একটি চুক্তির সম্ভাবনা থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল, ইরানকে আরও চেপে ধরলে এবং কঠোরতর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিলে তাদের কাছ থেকে অধিকতর ছাড় আদায় করা যাবে, এমনকি সামরিক আগ্রাসনেরও হুমকি দেওয়া যেতে পারে।
আমরা জানি, বুশের কৌশলের কী ফল হয়েছে: আলোচনা ভেস্তে যায়, আপস বা চুক্তিও তখন হয় না। আজ একটি চুক্তি হয়েছে, কিন্তু এক দশক আগে যদি সেটা করা যেত, তাহলে তা আরও ভালো হতো। এ বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার, কারণ সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পাশ থেকে চেঁচামেচি শুরু করেছেন।
এটা স্রেফ চুক্তি নয়, এর মাধ্যমে এনপিটি আরও পাকাপোক্ত হবে। এই চুক্তির বদৌলতে ইরানের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়ায় আসা সম্ভব হতে পারে, পশ্চিম এশিয়ায় চলমান সহিংসতার রাশ টেনে ধরার লক্ষ্যে বৃহত্তর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ।

ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ক্রিস প্যাটেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।