ইলিশ কেন বেজার

পদ্মা–মেঘনা নয়, এবারের মৌসুমে সেন্ট মার্টিন উপকূলে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে। কক্সবাজার থেকে তোলা।
ছবি: প্রথম আলো

সাগরে অঢেল ইলিশ। নদীতে নেই। এ রকম ঘটনা কিন্তু কয়েক বছর ধরেই ঘটছে। ইলিশ আদতে সাগরেরই মাছ। তবে নাইওরে তাকে আসতে হয় কুল রক্ষার জন্য ডিম পেড়ে জাটকা ফুটানোর তাগিদে। প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরত্বের এক লম্বা সফরে উপমহাদেশের নদীতে পাড়ি জমায় ইলিশ। বাংলাদেশের ভেতরে সে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে আসে। উপমহাদেশের সেরা ইলিশ মেলে বাংলাদেশের পদ্মা (গঙ্গার কিছু অংশ), মেঘনা (ব্রহ্মপুত্রের কিছু অংশ) এবং দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী নদীতে। দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও এই মাছ পাওয়া যায়। সেখানে ইলিশকে ‘পাল্লা’ নামে ডাকা হয়। এই মাছ খুব অল্প পরিমাণে থাট্টা জেলাতেও মিলত। বর্তমানে সিন্ধু নদের জলস্তর নেমে যাওয়ার কারণে পাল্লা বা ইলিশ আর দেখা যায় না।

তবে কি পদ্মা-মেঘনায় সিন্ধুর অসুখ ভর করেছে? আমাদের নদীগুলোতেই কি জলস্তরবিষয়ক জটিলতা দেখা দিয়েছে? মানুষ আর তেলাপোকার মতো অন্য প্রাণীরা মানিয়ে চলতে বা অ্যাডজাস্ট করে নিজেকে শেষ করে আপস করে বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষ আপস করতে করতে পাপোশ হয়েও বেঁচে থাকতে পারে। মাছেরা পারে না। ডাইনোসরসহ অনেক প্রাণীই অসহনীয় পরিবর্তনকে সহনীয় করে নিতে না পেরে দুনিয়া থেকেই চলে গেছে।

একসময় চিলির হেক মাছের বাজার আর কদর ছিল দুনিয়াজোড়া। চিলি ধরেছে আর রপ্তানি করেছে। হেকের চাওয়া-পাওয়ার দিকে মন দেয়নি। প্রশান্তের হেক এখন পাড়ি জমিয়েছে আটলান্টিকে, সে ধরা দিচ্ছে নামিবিয়ার জেলেদের হাতে। হেক এখন নামিদের গর্ব। ইলিশ যেমন আমাদের ইজ্জত, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জাতীয় মাছের মর্যাদা, দূতিয়ালির পাসপোর্ট—সবই দেওয়া হয়েছে ইলিশকে; কিন্তু তার মনের কথা আর আবাস-প্রবাসের চাহিদা আমরা শুনিনি। শুধু দু-একটি মৌসুমে নিধন বন্ধ রেখে ইলিশ রক্ষা করা যাবে না। বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা (৯ ইঞ্চির ছোট ইলিশ) শিকার নিষিদ্ধ। ছোট ইলিশ বেড়ে ওঠার জন্য ইলিশের অভয়াশ্রমে সব ধরনের জাল ফেলা নিষেধ থাকে মার্চ-এপ্রিলে। মা ইলিশকে নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে দেওয়ার জন্য অক্টোবরে ২২ দিন নদীতে সব ধরনের মাছ শিকার বন্ধ রাখে সরকার। ইলিশ কি তার ডিম ছাড়ার সময় আর স্থান বদল করেছে? আমরা হলফ করে তা বলতে পারব না।

ইলিশ যেহেতু সাগরের মাছ, তাই সাগরের উপকূলে থাকা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ইলিশ রক্ষা আর তোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের জেলেদের নিবৃত্ত রাখলাম আর প্রতিবেশীর জালেরা খোলা মাঠে গোল দিল, সেটা ইলিশের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।

চিলির হেক মাছের মতো ইলিশ অন্য সাগরে না গিয়ে এখনো আমাদের সাগরেই আছে, তাই জেলেরা বলছেন, মাছ আছে সাগরে। তার আলামত মিলেছে নানা জায়গায়।

হেক মাছ
ছবি: সংগৃহীত

বরগুনার পাথরঘাটা থেকে একসঙ্গে ১৫টি মাছের ট্রলার বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকারে গিয়েছিল। টানা পাঁচ দিন সাগরে জাল ফেলে ১২ আগস্ট রাতে ১৪টি ট্রলারই পাথরঘাটা ফিরে আসে সামান্য মাছ নিয়ে। ফেরে না একটা ট্রলার। তারা আরও ১২ ঘণ্টা একটানা ট্রলার চালিয়ে সেন্ট মার্টিন থেকেও গভীরে পৌঁছে সেখানে জাল ফেলে। ট্রলারের প্রধান মাঝির ভাষায়, ‘এক খেওতে এত মাছ উঠছে যে বোট ভইরা গেছে। মাছ রাহনের আর জাগা ছিল না। আর খেও দেই নাই। মাছ লইয়া চইলা আইছি।’ এটা কিন্তু খুব আনন্দের লক্ষণ নয়। ইলিশের ঝাঁক এই ভাদ্র মাসেও পাথরঘাটা, ভোলা বা চাঁদপুরের কূলে-কিনারায় নেই। ইলিশের জন্য এখন বড় দমের বড় জালের ট্রলার লাগছে। বড় পুঁজির বড় জালে অন্য অনেক জলজ প্রাণী ছোট-বড় মাছ ধরা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় ছানাপোনাসহ। ইলিশের নারাজ হওয়ার আরও অনেক কারণ আছে—

খুঁটি জালের বাধা/মোহনায় জালের ভিড়
সাগর-নদীর মোহনায় জেলেরা প্রচুর জাল ফেলে রেখেছেন। এ কারণে ওই জাল এড়িয়ে বড় আকারের ইলিশগুলো নদীতে আসতে পারছে না। আগে আবহাওয়া খারাপ থাকলে জালগুলো ওই সময়ের জন্য সরিয়ে নেওয়া হতো, সেই সুযোগে সাগর থেকে ইলিশ নদীতে ঢুকতে পারত, মাছও আরও বেশি ধরা পড়ত। সেটা আর এখন হচ্ছে না, তাই নদীতে কিছু ছোট ইলিশ, মানে জাটকার ছাড়া তেমন মাছ মিলছে না। আকারে ছোট হওয়ায় সাগরের মোহনায় পেতে রাখা জালের ফাঁস দিয়ে বেরিয়ে নদীতে চলে আসছে। কিন্তু বড় আকারের স্ত্রী ইলিশগুলো ওই জালের ফাঁসে আটকে যাচ্ছে।

ইলিশ যেহেতু সাগরের মাছ, তাই সাগরের উপকূলে থাকা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ইলিশ রক্ষা আর তোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের জেলেদের নিবৃত্ত রাখলাম আর প্রতিবেশীর জালেরা খোলা মাঠে গোল দিল, সেটা ইলিশের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।

নদীদূষণ ও নদীর পানিতে খাবারে স্বল্পতা
অন্য যেকোনো সময়ের থেকে কৃষিজমিতে কীটনাশকের ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে গেছে। সব কীটনাশকের শেষ গন্তব্য নদী। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়েই চলেছে মাছের চলার পথে আর প্রজনন এলাকায় যান্ত্রিক জলযানের অবাধ চলাচল। এসব জলযান থেকে পোড়া তেল আর বর্জ্য নদীতে ফেলা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। নদী আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি দূষিত। এসব দূষণের কারণে ইলিশ নদীতে খাদ্য ও পরিবেশ সংকটে পড়ছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের সাবেক ডিন বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ড. আবদুস সালাম মনে করেন, নদীদূষণ বন্ধ করতে না পারলে ইলিশ রক্ষা করা যাবে না।

নাব্যতা হ্রাস
নদীভাঙন ও বন্যার কারণে প্রতিবছর পদ্মা ও মেঘনায় অসংখ্য চর সৃষ্টি হয়ে নদী ভরাট হচ্ছে। এতে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মেঘনার দুটি, আন্ধারমানিক-পায়রা নদের দুটি, তেঁতুলিয়া ও ধলেশ্বরীর একটি করে মোট ছয়টি সংযোগ মোহনা দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশ আসে বাংলায়। এসব মোহনা কমপক্ষে ৫০ ফুট গভীর থাকার কথা। অনেক নদীর মোহনার গভীরতা কোথাও কোথাও ১০ ফুটে নেমে এসেছে। যে কারণে ইলিশ সাগর ছেড়ে নদীতে প্রবেশ কমে গেছে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে যেভাবে নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে, তাতে ইলিশের গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে সাগরে পানির তাপমাত্রায় নানা রকমের হেরফের লক্ষ করা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইলিশের পেটে ডিম আসার সময় পিছিয়ে গেছে। এ কারণে ইলিশের জীবনচক্রেও পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক নয়।

নদী ড্রেজিং
মজার বিষয়, বছরে ইলিশ রক্ষার নামে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব নদীর জেলেদের বছরে দু-তিনবার কর্মহীন রাখার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মেশিন দিয়ে নদী খোঁড়ার কাজ এক দিনের জন্যও বন্ধ রাখা হয় না। ইলিশের প্রজননকালে নদীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তোলা অব্যাহত থাকায় ইলিশের ডিম ও রেণু পোনার ক্ষতি হয়। নানা গবেষণায় এ বিষয় উঠে এলে এখন পর্যন্ত বিবেচকদের বিবেচনায় বা নজরে আসেনি। এলেও তার কোনো প্রমাণ মেলেনি কাজে বা পরিকল্পনায়।

পকেট জালের ব্যবহার
কয়েক বছর ধরে বড় বড় ইলিশের ছবি আমাদের সফলতার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে। আমরা খতিয়ে দেখিনি হঠাৎ বড় বড় ইলিশ আসছে কীভাবে? অনেক জেলে এখন আর গুলটি জালে মাছ না ধরে বড় আকারের পকেট জাল ব্যবহার করছেন। এই জালগুলোয় সহজেই মা মাছ ধরা পড়ে ডিম ছাড়ার আগেই। বিশিষ্ট মৎস্য, নদী ও পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া অনেক দিন থেকেই এই জালের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সাবধান করে আসছেন।ৎ

কী কী কারণে ইলিশের মন খারাপ, সেটা নিয়ে ওপরের আঁচ-অনুমানভিত্তিক ধারণা থেকে একটা উপসংহার টানা যেতে পারে, কিন্তু প্রয়োজন ধারাবাহিক গবেষণা। গবেষণার ফলাফলভিত্তিক উপাত্ত নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। অন্যথায় প্রতিকূল পরিবেশে ইলিশের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। বদ্বীপ পরিকল্পনা কি এটা নিয়ে একটু ভাবতে পারে?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: nayeem5508 @gmail.com