ইসরায়েল এখন কেন এত বেপরোয়া

ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কয়েকটি ভবন

ইসরায়েলের জন্য ফিলিস্তিনি হত্যার অজুহাত লাগে না। প্রতিটি রোজার মাসে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি হত্যা করে। এটা তাদের বছরওয়ারি উৎসব। তাই তাঁরা ভুল বলেন যাঁরা বলেন, হামাস রকেট ছুড়েছে বলে ইসরায়েল মিসাইল মারতেই পারে। ইসরায়েল তার অবৈধ বসতি বিস্তার এক মুহূর্তের জন্যও থামায়নি। ইসরায়েল তার সীমান্তকে ওদিকে নীল নদ, এদিকে জর্ডান নদী, আরেক দিকে ফোরাত নদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনাও কখনো লুকায়নি। ইরাক-মিসর-সৌদি আরব-জর্ডান ও সিরীয় ভূখণ্ড দখল করে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করাই তাদের নিরুপায় পরিকল্পনা। নিরুপায়, কারণ আরব রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে না ফেললে ইসরায়েল কখনো নিরাপদ হবে না।

অস্তিত্ব টেকাতে ইসরায়েলকে বর্বর হতেই হবে। তারা ভালো করেই জানে, আরবকে বিভক্ত করে শাসন করার চিরকালীন নিশ্চয়তা নেই। গত কয়েক মাসে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। একদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে। তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে সৌদি জোট ও মিসর। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পতন তো দৃশ্যমান, ট্রাম্পের কল্যাণে রাজনৈতিকভাবেও দেশটা ভয়ানক বিভক্ত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র অটোমান সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চল দখল করে নেয়। অধিকৃত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এবং সদ্য আবিষ্কৃত তেলের খনির বখরা এবং বিশ্ববাণিজ্যের ধমনি সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি পাহারাদার নিযুক্ত করে তারা। প্রায় একই সঙ্গে জন্ম নেয় সৌদি আরব ও ইসরায়েল। এই ঔপনিবেশিক যমজের জুটি ভাঙা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির প্রধান শর্ত। ইতিমধ্যে ফাটল দৃশ্যমান।

আমেরিকার ছাতা ফুটো হতে থাকছে আর তেলনির্ভর সৌদি আরব তার অর্থনীতিকে বহুমুখী করার চেষ্টা করছে। বিনিয়োগ করছে বিভিন্ন দেশের শিল্প ও ব্যবসায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ে দুনিয়াও তেলনির্ভরতা থেকে বেরোতে চাইছে। ইয়েমেনে আগ্রাসন আর কাতার অবরোধের ব্যর্থতা সামলাতে এখন তাদের শান্তি প্রয়োজন। আর শান্তি এলে মার্কিন-ইসরায়েলি অস্ত্রের বাজার চুপসে যাবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে কাবু আমেরিকা ইসরায়েলকে ফি বছর ট্রিলিয়ন ডলারের মদদ দেবে কী করে? তা ছাড়া রুশ-চীনা-তুর্কিরা ভাগ বসাচ্ছে ইসরায়েলি সমরাস্ত্রের বাজারে। ইসরায়েলের বিখ্যাত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষার মধ্যেও যে ছিদ্র আছে, হামাসের ছোড়া রকেট তা দেখিয়ে দিচ্ছে। হামাস ৯০টি রকেট ছুড়ে আয়রন ডোমকে ব্যতিব্যস্ত করে যাতে অন্তত ১০টি ফিলিস্তিনি মিসাইল লক্ষ্যে আঘাত হানে।

যদিও বিশ্ব জনমত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ইসরায়েলবিরোধী, তবু জায়নবাদ বেপরোয়া। এসব দুর্বলতার লক্ষণ। কারণ তারা জানে, হাতে সময় কম। চীন-রাশিয়াকেন্দ্রিক বিশ্ব বা বিশ্বক্ষমতার ভরকেন্দ্রে যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের আগে অন্তত সমগ্র জেরুজালেম ফিলিস্তিনিমুক্ত করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিতেই হবে তাদের।

সুতরাং যাঁরা বলেন, হামাসের উসকানিতে ইসরায়েল বেপরোয়া; তাঁরা খাদের তল মাপতে ভুল করছেন। জায়নবাদ তার পূর্বঘোষিত লক্ষ্য হাসিলে সহিংসতা চালাতে বাধ্য।

জায়নবাদীদের ভয় তাদের পেটের মধ্যেই। ইসরায়েলের আরব ও মুসলিম জনসংখ্যা বর্তমানে ২০ শতাংশ। এরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে না। ৪০ বছরের মধ্যে আরব, মুসলিম এবং জায়নবাদবিরোধী আলট্রা-অর্থোডক্স ইহুদিরা জনসংখ্যার অর্ধেকে পৌঁছাবে। কোনো গণতান্ত্রিক উপায়ে জনসংখ্যার অর্ধেক কেন, ২০ শতাংশকেও অধিকারহারা করা যায় না। ইসরায়েল তাই একই সঙ্গে জায়নবাদী ও গণতান্ত্রিক থাকতে পারে না। পারছেও না। দুই বছরে পরপর চারটি নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। টেকসই কোয়ালিশনও গড়ে উঠছে না। এই রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ঢাকতেই তাদের যুদ্ধ দরকার, ঘৃণার রাজনীতি দরকার। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রাজনৈতিক ভরাডুবি ঠেকাতে তাই বলি করেছেন আল–আকসা মসজিদ ও তার পাহারাদার ফিলিস্তিনিদের।

জায়নবাদীরা ১৯৪৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে গায়ের জোরে ইসরায়েল কায়েম করার সময় বলেছিল, বৃদ্ধরা মরে যাবে আর তরুণেরা ভুলে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। ফিলিস্তিনিরা ৭০ বছর ধরে রক্ত দিয়ে জেরুজালেম ও আরব ভূমির সম্পূর্ণ বেহাত হওয়া ঠেকিয়ে যাচ্ছে। তাদের যে গণহত্যা করেও থামানো যাবে না, তা ২০১৪ সালের গাজা আর ২০০৬ সালের লেবানন দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধী আরব একাও বিজয়ী হতে পারবে না। বিশ্বক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলের যে লক্ষণ ফুটে উঠেছে, তার মাঝখানের ফাঁকটাই তাদের দরকার।

এটা তো গেল ভূরাজনীতির সম্ভাব্য সমীকরণ। নৈতিক অঙ্কেও ইসরায়েল দেউলিয়া। ১৯৪৮ সালের আগে পৃথিবীতে ইসরায়েল বলে বাস্তব কোনো দেশ ছিল না। পৃথিবীতে ইহুদি নেশন বা জাতি বলেও কিছু ছিল না। ছিল রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডহীন ইহুদি সম্প্রদায়। বাইবেল কথিত ‘ল্যান্ড অব ইসরায়েল’ ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝাত না, বোঝাত ইহুদিদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে। বাস্তবে ইহুদিরা ছিল কেনান ও জুডাহ নামের অঞ্চলে। খ্রিষ্টজন্মের আগে ও পরে মাত্র কয়েক শ বছর জেরুজালেমে ইহুদি রাজত্ব থাকলেও এর ভিত্তিতে প্রাচীন নগরীর সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস ও বর্তমান দখল করা নিপাট ডাকাতি।

৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানদের দ্বারা জেরুজালেম থেকে ইহুদিদের বিতাড়নেরও প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। মিসর থেকে ইহুদিদের দেশান্তরও উপকথা, ঐতিহাসিক সত্য নয়। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর মোজেস অ্যান্ড মনোথিইজম (১৯৩৯) বইয়ে তা দেখিয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষা বলছে, ইসরায়েলি ইহুদিদের ৯০ শতাংশই নৃতাত্ত্বিকভাবে আদি বনি ইসরায়েলের বংশধর নয়। বরং তাদের রক্তে বইছে মধ্যযুগীয় পূর্ব ইউরোপীয় খাজারি রক্ত। পনেরো শতকে খ্রিষ্টান ও মোঙ্গল আক্রমণে তারা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়। এই ইউরোপীয় ইহুদিরা হিব্রু ভাষায়ও কথা বলত না। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্লোমো স্যান্ডের বেস্টসেলার বই দ্য ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল এবং দ্য ইনভেনশন অব দ্য ল্যান্ড অব ইসরায়েল জায়নবাদীদের যাবতীয় দাবিকে অথই পানিতে ফেলে দিয়েছে।

স্লোমো স্যান্ড দাবি করেন, ফিলিস্তিনিরাই আসলে মুসলমান হওয়া আদি ইহুদির বড় অংশ। আর যিশুও ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি যুবক। ইহুদিরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হয়ে যদি মাথা তুলতে পারে, তাহলে যিশুর পুনরুত্থানের মতো পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের পুনরুত্থানও সম্ভব। তা জরুরিও। কেননা, ফিলিস্তিনিরা আজ ইহুদিদের মতোই হলোকস্টের শিকার; বিশ্বমানবতার অপর নাম। ফিলিস্তিনকে মুক্ত না করে তাই মানবতা মুক্ত হতে পারবে না।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]