ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দুই ইহুদির আইসক্রিম–যুদ্ধ

বিশ্বজুড়ে এ রকম মিথ আছে, ইসরায়েল অপরাজেয় শক্তি। কিন্তু বন্দুক, কামান, মিসাইল ছাড়াই এই মহাশক্তির নৈতিক পাটাতন ধরে টান দিয়েছে আইসক্রিম কোম্পানি বেন অ্যান্ড জেরি। গত পাঁচ দশকে ইসরায়েল সাংস্কৃতিকভাবে এমন বেকায়দায় আর পড়েনি। স্বাভাবিকভাবে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েল–প্রভাবিত মিডিয়াগুলো বেন অ্যান্ড জেরির বিরুদ্ধে লেগেছে। এই প্রচারণা দেখে এমন প্রশ্নও সামনে আসছে, সামান্য আইসক্রিম কোম্পানি যে সাহস দেখাতে পারল, মধ্যপ্রাচ্যের ‘শেখ’রা কেন তা পারে না।

দুই বন্ধুর ‘কাউন্টার কালচার’

‘বেন অ্যান্ড জেরি’ মূলত আইসক্রিম ও নানান পানীয় তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টে তাদের স্থাপনা। এই ভারমন্টেরই সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। স্যান্ডার্সের সূত্রে ভারমন্টের প্রগতিশীল ইমেজ আছে। তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে দিল বেন অ্যান্ড জেরি। সম্প্রতি তারা ঘোষণা দিয়েছে, ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তারা পণ্য বেচবে না।

বেশি পুরোনো কোম্পানি নয় বেন অ্যান্ড জেরি। দুই ইহুদি তরুণ ১৯৭৮-এ শুরু করেন এই কাজ। এখন উভয়ে তাঁরা ৭০-এ পড়েছেন। এই দুই বন্ধু দূরশিক্ষণের মাধ্যমে আইসক্রিম তৈরির বিদ্যা শিখে এই কারবারে নামেন। আইসক্রিমের মতো খাবারে রাসায়নিকযুক্ত দুধ মেশানোর বিরুদ্ধে প্রচারে নেমে বেন অ্যান্ড জেরি খ্যাতি পায়।

বেন কোহান ও জেরি গ্রিনফিল্প নামের এই দুই বন্ধু ব্যবসাকে সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে চাইতেন। আমেরিকায় টিটকারি করে তাঁদের ‘কাউন্টার কালচার ক্যাপিটালিস্ট’ও বলা হয়। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত চেতনা বিসর্জন দিতে রাজি নন তাঁরা। মুমিয়া আবু-জামালের মুক্তি চেয়ে আন্দোলনে শামিল হতেও দেখা গেছে বেন কোহেনকে। মুমিয়া আমেরিকার বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ রাজবন্দী। ২০১৬ সালে দুই বন্ধু একবার একসঙ্গে গ্রেপ্তারও হন নির্বাচনে করপোরেটদের ভূমিকা বন্ধের দাবিতে মিছিল করে। তবে এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর ২০০০ সালে আইসক্রিম কোম্পানিটি বিক্রি করে দেন তাঁরা ব্রিটেনের বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের কাছে। বিক্রির সময় শর্ত ছিল, তাঁদের এত দিনকার মূল্যবোধ যেন ইউনিলিভার ‘বেন অ্যান্ড জেরি’ থেকে খারিজ না করে। অর্থাৎ এর সামাজিক নীতির স্বশাসন থাকতে হবে। সেই ধারাবাহিকতাতেই সর্বশেষ ঘটনার শুরু। জুলাইয়ে এই কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, ইসরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি এলাকায় ২০২৩ থেকে আর আইসক্রিম বেচবে না তারা।

বেন অ্যান্ড জেরির সিদ্ধান্ত ইসরায়েলকে অচিন্তনীয়ভাবে বড় এক নৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। অনেক দেশ যখন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বর্বরতার মধ্যেও বন্ধুত্ব বাড়াচ্ছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে, তখন বেন অ্যান্ড জেরির ঘোষণা হাজার টনের বোমার চেয়েও যেন বেশি ক্ষয়ক্ষতির কারণ হলো তাদের জন্য।

ছোট্ট প্রতিবাদ যখন ঝড় হয়ে উঠল

ইউনিলিভারের অন্তর্ভুক্ত হলেও বেন অ্যান্ড জেরি সুবিশাল কোম্পানি নয়। ইসরায়েলের আইসক্রিমের চাহিদার সামান্যই পূরণ করে তারা। বড়জোর ১০ শতাংশ হবে। সমস্যাটি আসলে বেচাকেনা নিয়ে নয়। সাংস্কৃতিক যুদ্ধের আদল নিয়েছে সেটা। বেন অ্যান্ড জেরির সিদ্ধান্ত ইসরায়েলকে অচিন্তনীয়ভাবে বড় এক নৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। অনেক দেশ যখন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বর্বরতার মধ্যেও বন্ধুত্ব বাড়াচ্ছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে, তখন বেন অ্যান্ড জেরির ঘোষণা হাজার টনের বোমার চেয়েও যেন বেশি ক্ষয়ক্ষতির কারণ হলো তাদের জন্য। কেবল পশ্চিম তীর নয়, পূর্ব জেরুজালেমেও বেন অ্যান্ড জেরি আইসক্রিম বিক্রি করবে না, এমন ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া ইসরায়েলের উদারনৈতিকদের পক্ষেও কঠিন। বেন অ্যান্ড জেরি যখন বলে পূর্ব জেরুজালেমে তারা পণ্য বেচতে চায় না, তখন আসলে তারা ইসরায়েলের তরুণদের এটাই জানায়, এই জায়গা জবরদখল করা এবং সেখানকার ইহুদি বসতিগুলো দখলদারমাত্র। এ রকম দখলদারির বিরুদ্ধে গত ৫৪ বছরে বিশ্বে বহু প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু একটা আইসক্রিম কোম্পানির অভিনব সামান্য প্রতিবাদ ইসরায়েলে এত বড় প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে যে দেশটির সবাই হতবিহ্বল এ মুহূর্তে।

আইসক্রিম যে কারণে ইসরায়েলের সর্বাত্মক প্রতিপক্ষ

বেন অ্যান্ড জেরির কারণে প্যারেন্ট কোম্পানি ইউনিলিভারের কপালে কী দুর্ভোগ আছে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। ব্রিটেনে ইসরায়েল লবি শক্তিশালী। ইসরায়েলকে খ্যাপালে কী হয়, ব্রিটেনে তার সাক্ষী লেবার দলের রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিন। তুমুল জনপ্রিয়তার পরও তাঁকে সর্বশেষ নির্বাচনে ধরাশায়ী করায় ইসরায়েলের ভালো ভূমিকা ছিল। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সামরিক অপরাধকেও অনেক প্রচারমাধ্যম সেখানে ‘ইহুদিবিরোধী ঘৃণা’ হিসেবে দেখে। বেন অ্যান্ড জেরির আইসক্রিমকে এরই মধ্যে ‘অ্যান্টিসেমেটিক আইসক্রিম’ বলা হচ্ছে। ইউনিলিভারের শেয়ারের দরও কিছুটা ফেলে দেওয়া গেছে।

বেন অ্যান্ড জেরিকে থামাতে সব আদর্শের ইসরায়েলি রাজনীতিবিদেরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে ইউনিলিভারকে চাপ দিচ্ছেন। ইউনিলিভাবের পণ্য বর্জনের হুমকিও আছে চাপের তালিকায়। ইসরায়েল চাইছে, আমেরিকার রাজনৈতিক প্রশাসনে তার যে প্রভাব রয়েছে, সেটাকে ব্যবহার করে বিশেষভাবে ওই দেশে বেন অ্যান্ড জেরিকে ধরাশায়ী করতে। সাবেক প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু ইতিমধ্যে টুইটারে লিখেছেন, ‘আমরা জানি কোন আইসক্রিম কিনতে হবে না।’ এটা আসলে আমেরিকার ইহুদিদের প্রতি পরোক্ষ আহ্বান বেন অ্যান্ড জেরিকে বর্জনের জন্য। ইতিমধ্যে এমন কূটনৈতিক তথ্যও ফাঁস হয়েছে, ইসরায়েল দেশে দেশে তার দূতদের বেন অ্যান্ড জেরির বিরুদ্ধে প্রচার গড়তে ‘বন্ধু’ সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে ইউনিলিভারের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ৩৫ রাজ্যে গভর্নরকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে তারা।

ফিলিস্তিনিরা বেন অ্যান্ড জেরির সাহসিকতায় উজ্জীবিত। তবে তারা একই সঙ্গে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করছে, বেন অ্যান্ড জেরি যা পারে, এতগুলো দেশ মিলে সেটা পারে না কেন?

বেন অ্যান্ড জেরি যা পারে, ওআইসিভুক্তরা সেটা পারে না কেন

বেন অ্যান্ড জেরির এ ঘোষণার তীব্র প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রেও। এটি সেখানে সামাজিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে এমনকি পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইসকেও মন্তব্য করতে হলো। যে মন্তব্য ছিল আবার কপটতায় ভরা। সরাসরি বেন অ্যান্ড জেরির নাম না নিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় যেকোনো একক দেশের বিরুদ্ধে বর্জন আন্দোলনের বিপক্ষে।

তবে ফিলিস্তিনিরা বেন অ্যান্ড জেরির সাহসিকতায় উজ্জীবিত। তবে তারা একই সঙ্গে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করছে, বেন অ্যান্ড জেরি যা পারে, এতগুলো দেশ মিলে সেটা পারে না কেন? বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ হয়েও মুসলমানরা যে তাদের শাসকদের কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক বা সাংস্কৃতিক শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না, সেটাই জানিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের এ প্রশ্নে।

তবে তথ্য-উপাত্ত এ–ও দেখায়, সমস্যাটা কেবল মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর শাসকদের নয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এবং নেই, এমন উভয় ধারার মুসলমানপ্রধান দেশ থেকে নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমণ বাড়ছে। টাইমস অব ইসরায়েল–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে ‘পর্যটকদের’ ইসরায়েল যাওয়া বছরওয়ারি প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়ছে। এর মধ্যে এগিয়ে ইন্দোনেশিয়ার মতো ‘রক্ষণশীল’ দেশের নাগরিকেরাও। তেল আবিবের দিকে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর আগ্রহ ক্রমে কূটনীতি ছাড়িয়ে বাণিজ্যের দিকে এগোচ্ছে এবং মিসর, জর্ডান, তুরস্ক, আরব আমিরাত, মরক্কো বা বাহরাইনে কেবল সেটা সীমিত নেই। একই তরঙ্গ আসছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকেও। বেন অ্যান্ড জেরির আইসক্রিম যখন প্রতিরোধের সংস্কৃতিতে জমাটবাঁধা শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেল, ঠিক তখন ওআইসিভুক্তদের ইসরায়েল বর্জন অলক্ষ্যে গলে গলে উধাও।

আলতাফ পারভেজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাস বিষয়ে গবেষক