ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অবসান

সাঈদ ইব্রাহিম রাইসি

১৮ জুন অনুষ্ঠিত ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল ইসলামি শাসনতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রহসনের নির্বাচন। এমনকি ২০০৯ সালেও এমন হাস্যকর নির্বাচন হয়নি, যে নির্বাচনকে প্রায়ই ‘নির্বাচনী অভ্যুত্থান’ বলা হয়।

এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সাঈদ ইব্রাহিম রাইসি। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। প্রায় তিন দশক আগে চার হাজার ভিন্নমতাবলম্বী মানুষকে হত্যায় তাঁর ভূমিকা রয়েছে—এমন অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। রাইসির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তদন্ত করার জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে আহ্বান জানিয়েছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে নবনির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট এমনভাবে উত্তর দিয়েছেন যে তাঁর উত্তর শুনলে স্বয়ং জর্জ ওরয়েল লজ্জায় পড়ে যেতেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের ফলে বরং মানবাধিকার রক্ষা পেয়েছে এবং এ জন্য তাঁর প্রশংসা করা উচিত।

রাইসির পক্ষে বিপুল ভোট নিশ্চিত করতে ইরান সরকার তার সব বাহিনীকে একত্র করেছিল। নির্বাচনের আগপর্যন্ত রাইসি ছিলেন দেশটির প্রধান বিচারক। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি জনগণকে আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ভোট প্রদান একটি ধর্মীয় দায়িত্ব এবং ব্যালট পেপার ফাঁকা রাখা পাপ। তিনি যখন এসব বলছিলেন, তখন তাঁর ধর্মীয় মিত্ররা অবশ্য ভোট বর্জনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। তারা বলছিল, এসব ধর্মবিরোধী কাজ। কিন্তু সরকারি হিসাবমতে, ৫১ শতাংশ ভোটার ভোট দেননি। আর যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৪০ লাখ ভোটার ব্যালট পেপার ফাঁকা রেখেছেন। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে যে যেসব ভোট পড়েছে, সেগুলোও জাল ভোট। এসব কারণে নির্বাচনের ফলাফল বর্জনের একটি শক্তিশালী আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং আন্দোলনকারীরা একটি ভার্চ্যুয়াল গণভোটের আয়োজন করেছে।

সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা আসলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার হাতেই রয়েছে। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে প্রথম কয়েক বছর ছাড়া বাকি সব নির্বাচন ছিল সুপরিকল্পিত। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সব সময় আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি দেশগুলোর কাছাকাছি ছিল। কিন্তু রাইসির নির্বাচনের পর ইরানকে একটি স্বৈরাচারী সরকার বলে ডাকার প্রবণতা বাড়বে। এই পরিকল্পিত নির্বাচনে দলগুলো অংশ নিয়েছিল ক্ষমতাকে বিভক্ত করার জন্য।

সুতরাং এটি শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল না, পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কে হবেন, তারও নির্বাচন ছিল এটি। খামেনির বয়স এখন ৮২, দীর্ঘদিন ধরে প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, পরবর্তী শীর্ষ নেতা হবেন খামেনির ছেলে মোজতবা। এভাবেই পদটিকে বংশানুক্রমিক করে তোলা হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন রাইসি হবেন এমন এক প্রেসিডেন্ট, যিনি মোজতবার উত্থানকে নির্বিঘ্ন করবেন।

এটি স্পষ্ট যে অবকাঠামোগত কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে এই সরকারের, যেমন অনাবৃষ্টি, কোভিড-১৯, ধসে পড়া অর্থনীতি, বর্ণবাদ বিলোপের দাবিতে নারী আন্দোলন, তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ইত্যাদি। এসব সমস্যা দেশ–বিদেশে ইরানের শক্তিকে খর্ব করেছে। এসব সমস্যার কারণে নাগরিকদের ওপর বর্বরতা, দ্বৈত নাগরিকদের অপহরণ, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা ইত্যাদি বেড়েছে।

রাইসি যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অফিস করতে শুরু করবেন, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলমান আলোচনাগুলোর পাশাপাশি ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তির কিছু সংস্করণ পুনরায় উত্থাপন করবে। ২০১৮ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন এই চুক্তি থেকে সরে আসেন, তখন কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এখন সেসব নিষেধাজ্ঞার অবসান হবে বলে আশা করা যায়। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ছিল ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করা’। এই নীতি সাধারণ ইরানিদের ব্যাপকভাবে আঘাত করেছে এবং শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। দুর্বৃত্ত শাসনব্যবস্থার সঙ্গে আলোচনা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিমান নীতি, তবে এ–জাতীয় শাসনব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।

ইরানের ‘ক্ষমতা পরিবর্তন’ এবং ‘ক্ষমতাধর তুষ্টকরণ’ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওকালতি করা নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই একধরনের মিথ্যা বিতর্ক প্রায়ই দেখা যায়। ইরানের সঙ্গে সমঝোতা করতে গিয়ে বাইডেন প্রশাসনকে এ দুটি বিষয় অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে। ইরান যদিও চুক্তি থেকে সরে আসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সমালোচনা করেছে, তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে সমঝোতার ব্যাপারে খামেনিকেই দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানানো। সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) আলোচনার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে খামেনি যুক্ত ছিলেন।

ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারে না। কেবল ইরানের জনগণই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেটাই উচিত। তবে ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনাগুলো অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে করা উচিত। ইরানের জনগণ যেন বুঝতে পারে যে এসব সমঝোতাভিত্তিক আলোচনা কেবল আধুনিক গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব, ইসলামি খেলাফতের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

খামেনি ও তাঁর সহযোগীদের উল্টো পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিচ্ছে রাইসির এ নির্বাচন। সামনের বছরগুলোতে ইরানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ইরানের এ সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই একটি বিচক্ষণ কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

আব্বাস মিলানি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক ও হুভার ইনস্টিটিউশনের গবেষণা ফেলো