ইসলামে আপ্যায়ন-আতিথেয়তার গুরুত্ব ও বিধান

আপ্যায়ন মানে মেহমানদারি। আতিথেয়তা অর্থ অতিথিসেবা। অতিথি হলো মেহমান। যাঁর অতিথি হয়, তিনি হলেন মেজবান। অতিথিসেবা ও আপ্যায়ন মানুষের অন্যতম সেরা গুণ। অতিথিপরায়ণতা উদারতা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির আচরণের প্রতীক। সব নবী ও রাসুল অতিথিপরায়ণ ছিলেন। বিশেষত, মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আতিথেয়তায় ছিলেন অনন্য। তিনি দিনে অন্তত এক বেলা মেহমান ছাড়া আহার করতেন না।

হজরত ইব্রাহিম (আ.)–এর কাছে পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)–এর জন্মের সুসংবাদ এবং তাঁর বংশে হজরত ইয়াকুব (আ.) আগমনের বার্তা নিয়ে কয়েকজন ফেরেশতা মেহমানরূপে এসেছিলেন। তিনি গরু জবাই করে তাঁদের জন্য মেহমানদারির আয়োজন করেছিলেন। বিষয়টি কোরআন মাজিদে রয়েছে, ‘আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইব্রাহিমের নিকট গেল। তারা বলল “সালাম।” তিনিও বললেন “সালাম।” তিনি অবিলম্বে একটি কাবাবকৃত গোবৎস পরিবেশন করলেন।’ (সুরা-১১ হুদ, আয়াত: ৬৯)

বাড়ি নির্মাণ করলে সেখানে মেহমানের জন্য বিশেষ ঘর বা কক্ষের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ হাদিস শরিফে রয়েছে। একজন মেহমান এক গৃহে একবারে তিন দিন থাকার হক বা অধিকার রাখেন। মেহমানদারি করলে রিজিক বাড়ে, উপার্জনে বরকত হয়, গৃহে শান্তি আসে, জীবন সুখের হয়। অতিথি আল্লাহর রহমত নিয়ে আসেন। অতিথির সঙ্গে বরকত আসে। অতিথি দস্তরখানে তাঁর জন্য বরাদ্দ রিজিকই আহার করেন। অতিথির অছিলায় আল্লাহ তাআলা আমাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেন, বিপদ-আপদ দূর করেন।

মেহমানকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা, সাদর সম্ভাষণ জানানো মেজবানের কর্তব্য। পরিবারের সদস্যদের মেহমানের পরিচয় জানিয়ে দেওয়া, আত্মীয় কুটুম হলে তার সঙ্গে রিশতা বা সম্পর্ক কী, তা-ও জানানো উচিত। মেহমান আসার সঙ্গে সঙ্গে পানি, শরবত ও যা সহজ হয়, এমন কিছু দিয়ে তাৎক্ষণিক হালকা নাশতার ব্যবস্থা করা উচিত। ঠিক খাবারের সময় বা খাবারের আগে-পরে নিকটতম সময়ে মেহমান এলে উপস্থিত যা আছে, তা-ই দিয়ে আপ্যায়ন করা যেতে পারে। মেহমানের অজু-গোসলের ব্যবস্থা ও ইবাদতের সুযোগ করে দিতে হবে।

সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো জায়গায় থাকার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা এবং সাধ্যমতো উত্তম পানাহারের আয়োজন করা; সম্ভব হলে মেহমানের চাহিদা ও রুচি জেনে সেভাবে সেবা করার চেষ্টা করা। অন্তত তিন দিন সুন্নাত মেহমানদারির নিয়ত করা। হজরত লুত (আ.)–এর জাতিকে তাদের অবাধ্যতা, পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে মেহমান বেশে সেখানে গিয়েছিলেন। হজরত লুত (আ.) এই মেহমানদের থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন, খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিষয়টি কোরআন মজিদে উল্লেখ রয়েছে, ‘আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা লুত (আ.)–এর নিকট গেল, তখন তাদের আগমনে (তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে) তিনি বিষণ্ন হলেন এবং নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করলেন ও বললেন, “ইহা নিদারুণ দিন।”’(সুরা-১১ হুদ, আয়াত: ৭৭)

অভাব-অভিযোগ ও সমস্যার কথা মেহমানকে বুঝতে না দেওয়া দরকার, যাতে মেহমান বিব্রত বোধ না করেন। এ বিষয়ে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘আর তারা তাদের (মেহমানদের) নিজেদের ওপর প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ৯)

মেহমানকে হাদিয়া বা উপঢৌকন দেওয়াও সুন্নাত। মেহমানের জন্য পাথেয় বা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবারদাবার বা অন্য কোনো সামগ্রী উপহার দেওয়া উচিত। মেহমানদারিতে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা, মেহমানের কাছে দোয়া চাওয়া এবং আবার আসার জন্য আন্তরিকভাবে আবেদন রাখা দরকার।

মেজবান ও তাঁর বাড়ির জন্য কিছু হাদিয়া বা উপহার নিয়ে যাওয়া মেহমানের জন্য সুন্নাত। মেজবান যেভাবে আতিথেয়তা করবেন এবং যা আপ্যায়ন করবেন, খুশি মনে তাতে সন্তুষ্ট থাকা সুন্নাত। খাবারের যত পদ পরিবেশন করা হবে, সব পদ থেকে সামান্য করে হলেও গ্রহণ করা উচিত। খাবারের দোষ বর্ণনা না করা এবং আতিথেয়তা আপ্যায়নের ত্রুটি না ধরা সুন্নাত। এমন কোনো আচরণ না করা, যাতে মেজবান বিরক্ত বা বিব্রত হন। মেজবানের পরিবারের সদস্য বা অন্য কোনো আত্মীয় বা পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে মেজবান পরিচয় না করিয়ে দিলে আগ বাড়িয়ে কথাবার্তা না বলা এবং ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা না করা উচিত। এমন কোনো কিছু না করা, যাতে মেজবানের অমর্যাদা হয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]