ইসলামের আলোকে নিরাপদ মাতৃত্ব ও নবজাতকের পরিচর্যা

আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতি হাতে আদি পিতা আদম (আ.) কে সৃষ্টি করলেন, তাঁর থেকে সৃষ্টি করলেন আদি মাতা হাওয়া (আ.)–কে। এ যুগলের মাধ্যমেই মানব প্রজন্ম পরম্পরা সূচনা করলেন, বিস্তার ঘটালেন মনুষ্য সভ্যতার। (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১)।

মানুষের কল্যাণ নিমিত্তে আল্লাহ তাআলা কুলমাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৯)। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন হেতু মানব জাতির সুরক্ষা, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। মানবসভ্যতার সুরক্ষার জন্য মানবশিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়মে মানবসন্তান পিতা-মাতার মাধ্যমেই পৃথিবীতে আগমন করে। তাই শিশুর যত্নের পূর্ব ধাপ হিসেবে তার পিতা-মাতার নীরোগ সুস্থ দাম্পত্যজীবন নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হতে হবে। এ জন্য সন্তান মাতৃগর্ভে আগমনের আগেই দম্পতি যুগলের শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তাদের উভয়কে স্বাস্থ্যসচেতন থাকতে হবে এবং অনাগত সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গর্ভকালে মায়ের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও তার প্রয়োজনীয় সেবাযত্ন অতীব জরুরি। এ সময় গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত ও প্রফুল্ল এবং প্রাণচঞ্চল থাকতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মীয় উপদেশ ও বিজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। কারণ সুস্থ মা-ই কেবল সুস্থ শিশু উপহার দিতে পারেন। এ বিষয়ে জগদ্বিখ্যাত কুমারী মাতা মরিয়ম (আ.)–এর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রসব-পূর্ব নির্দেশনা কোরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে, ‘তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করবে না, তোমার প্রভু তোমার পদতল হতে একটি ঝরনা উৎসারিত করছেন। আর তুমি খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড ধরে নিজের দিকে ঝাঁকাও, যাতে তোমার নিকট পরিপক্ব টাটকা তাজা খেজুর পতিত হবে। তুমি পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করো এবং তোমার চক্ষু শীতল করো।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ২২-২৬)।

নিরাপদ মাতৃত্বের চূড়ান্ত ধাপ হলো নিরাপদ প্রসব। বিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে, অভিজ্ঞ নার্স ও প্রশিক্ষিত ধাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব পর্ব সম্পন্ন করতে হবে। চিকিৎসক ও বিজ্ঞজনদের পরামর্শে পূর্ব থেকে সে আয়োজন করে রাখতে হবে। সন্তান প্রসবের পরও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য ও পুষ্টিকর খাবারের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে এবং মায়ের যত্নের পাশাপাশি নবজাতকের যত্ন নিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সেকালের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনেকগুলো একালে প্রযোজ্য নয়। যেমন: ওহুদ যুদ্ধে আহত সাহাবিদের ক্ষতস্থান ছাই দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল, এখন তা সুন্নাত নয়। বরং বর্তমানে আধুনিক উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করাই সুন্নাত

শিশুর পরিচর্যা মাতৃগর্ভে থাকাকালে শুরু করতে হয় তার মায়ের পরিচর্যার মাধ্যমে। এ সময় শিশু মায়ের দেহ থেকে সরাসরি তার আহার, খাবার-খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ করে থাকে। প্রসবের পর থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত বয়সী শিশুকে নবজাতক বলা হয়। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই তাকে শালদুধ খাওয়াতে হবে। শালদুধ শিশুর জন্য প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধক। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য খোদার অতুলনীয় দান। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে, যে চায় তার সন্তানকে তার মায়ের দুধ পান পূর্ণ করতে। আর সন্তানের পিতাগণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ওদের (সন্তানদের মায়েদের) জীবনোপকরণ (পুষ্টিকর খাবার) ও আরামদায়ক পোশাক (এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের) ব্যবস্থা করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৩৩)।

নবজাতকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু সুন্নাত আমল রয়েছে। এর কিছু আমল শুধুই ইবাদত আর কিছু আমল স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ইবাদত পর্বগুলো আমরা আলেম-ওলামাদের নির্দেশনা মোতাবেক পালন করব এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানবিষয়ক কর্মগুলো আমরা বিজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসরণে সম্পন্ন করব। মনে রাখতে হবে, সেকালের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনেকগুলো একালে প্রযোজ্য নয়। যেমন ওহুদ যুদ্ধে আহত সাহাবিদের ক্ষতস্থান ছাই দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল, এখন তা সুন্নাত নয়। বরং বর্তমানে আধুনিক উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করাই সুন্নাত।

শিশুসন্তানের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পিতা-মাতাসহ পরিবারের সব সদস্যকে এবং নবজাতক শিশুকে দেখতে আসা পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সামাজিক ও শারীরিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। ঘরদোর ও আঙিনা জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশুর ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং মশা-মাছিসহ নানা ধরনের কীটপতঙ্গের উপদ্রব থেকে নিরাপদ রাখতে হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]