ইয়াহিয়ার ক্ষমতালিপ্সা ও নারী সঙ্গীরা
হামুদুর রহমান কমিশন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত জীবনেরও সুুলুকসন্ধান করেছেন। তাঁদের তদন্তে প্রথমে এসেছে ইয়াহিয়া খানের নাম। ১৯৬৯ সালে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর সহায়তা চাইলে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সহযোগীরা অস্বীকৃতি জানান। ফলে আইয়ুব পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। শাসনভার হাতে নিয়ে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করলেও এর যথার্থতা সম্পর্কে হামুদুর রহমান কমিশন সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, পূর্বসূরি ইস্কান্দার মির্জার আমলের অভিজ্ঞতাই সম্ভবত তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছেন। নির্বাচনে কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কিংবা ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করতে না পারলে তাঁর হাতেই ফের ক্ষমতা ন্যস্ত হবে। সামরিক চক্র পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ কয়েকটি ডানপন্থী দলকে বেশি আসন পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
কমিশন জানায়, আমরা যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে নির্বাচনের ফল নিয়ে আসার জন্য অর্থ বিলিয়েছেন। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তাঁর স্ববিরোধী ও সন্দেহভাজন তৎপরতায়ই আসল উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন, এমনকি সে জন্য যদি পাকিস্তান ভেঙে যায়, সেই ঝুঁকি নিতেও রাজি। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেলে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এরপর ইয়াহিয়া খান নিজের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকেন এবং বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলীকে ব্যবহার করেন। আবার ৮১টি আসনে বিজয়ী ভুট্টোও বিরোধী দলের আসনে বসতে রাজি ছিলেন না।
কমিশন বলেছে, যদি ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য সৎ হতো, তাহলে তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেন। এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি মেনে নিয়ে তিনি কোনোভাবেই জনগণের রায় অগ্রাহ্য করতে পারেন না। ইয়াহিয়ার এটাও জানা উচিত ছিল যে শেখ মুজিব যে ছয় দফা দাবি পেশ করেছেন, তার ভিত্তিতে দুই অংশের মধ্যে কনফেডারেশন হতে পারে, ফেডারেশন নয়। আসলে ইয়াহিয়া খান ছয় দফা কর্মসূচি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেই দেখেননি। এমনকি মার্চের মাঝামাঝি যখন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, তখনো ছয় দফার ইংরেজি কপি খোঁজা হচ্ছিল। এ থেকেই ধারণা করা যায়, ইয়াহিয়ার আলোচনা ছিল লোকদেখানো। তিনি ভুট্টোকেও বিশ্বাস করতেন না।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে ইয়াহিয়া অযথা বিলম্ব করছিলেন। আবার ৩ মার্চ অধিবেশন ডাকলেও সেই অধিবেশন যাতে বসতে না পারে, সে জন্য সেনা কর্মকর্তারা কলকাঠিও নাড়তে থাকেন। পিপিপির নেতা ভুট্টো অধিবেশনে যোগ দেবেন না বলে জানিয়ে দেন। অন্যদিকে জেনারেল উমর ও রিজভীকে ব্যবহার করা হয়, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলও একই সিদ্ধান্ত নেয়। ভুট্টো সংবিধান রচনায় ১২০ দিনের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার দাবি জানালেও ইয়াহিয়া তা মেনে নেননি। কেননা তাতে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতো না। যেসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে এ কথা বলা যায় না যে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সহযোগীরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার বিষয়ে অনড় ছিলেন।
কমিশন বলেছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ হলো, তিনি চরম অনৈতিক জীবনযাপন করতেন; দিনের বেশির ভাগ সময় মদ ও নারী নিয়ে পড়ে থাকতেন। যুদ্ধের সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনগুলোতে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দপ্তরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে স্থাপিত অপারেশন রুমে তিনি দু-তিনবারের বেশি যাননি।
কমিশনের মতে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভীষণভাবে মাদকাসক্ত ছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু নারীর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল; যাঁরা সেই যুদ্ধের দিনগুলোতেও তাঁর অনেক সময় কেড়ে নিতেন। প্রেসিডেন্টের নারী সঙ্গীদের তালিকায় আছেন বেগম শামীম কে এন হোসেন; যিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইজির স্ত্রী, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী নূরজাহান, আকলিমা আখতার, যিনি জেনারেল নারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ছিলেন একজন সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তা। করাচির এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী নাজলী বেগম, মেজর জেনারেল (অব.)-এর সাবেক স্ত্রী জয়নব, মালিক স্যার খিজির হায়াত খান তিওয়ানার সাবেক স্ত্রী, তাঁরও নাম জয়নব। তাঁর নারী সঙ্গীদের তালিকায় আরও ছিলেন ঢাকার শিল্পপতি আনোয়ারা বেগম এবং লিলি খান ও নায়লা মোজাম্বিল নামের দুই নারী।
প্রেসিডেন্টের এডিসি মোহাম্মদ ইশহাক ও কমোডর খালিদ শফির সাক্ষ্য অনুযায়ী, এই নারীদের অধিকাংশ যখন-তখন প্রেসিডেন্ট হাউসে আসতেন এবং অনেক সময় সেখানে সময় কাটাতেন। তাঁরা প্রায়ই পরদিন খুব ভোরে প্রেসিডেন্ট হাউস ত্যাগ করতেন।
১৯৭১ সালের নভেম্বরে যখন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খুব নাজুক হয়ে পড়ে, ইয়াহিয়া খান দু-তিন দিন লাহোরের গভর্নর হাউসে কাটান; যেখানে সংগীতশিল্পী নূরজাহান দিনে দুই বা তিনবার আসতেন। তিনি প্রতি রাতে আটটার দিকে গভর্নর হাউসে ঢুকতেন। সাড়ে আটটায় এডিসির অফিস শেষ হওয়ায় তিনি বলতে পারেননি কখন বের হয়ে গেছেন।
বেগম শামীম ইয়াহিয়ার হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করেছিলেন। নভেম্বরে প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউস সরানোর আগ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। গেটে সংরক্ষিত সময়সূচি অনুযায়ী তিনি সন্ধ্যায় আসতেন এবং খুব ভোরে চলে যেতেন। মাঝেমধ্যে প্রেসিডেন্ট বেগম শামীমকে নিয়ে নৈশভোজের জন্য প্রেসিডেন্ট হাউস ত্যাগ করতেন এবং শেষ রাতে ফিরতেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁকে নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় বের হন এবং পরদিন বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ ফিরে আসেননি। ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের মতে, প্রেসিডেন্ট হাউসে তাঁর দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতি ছিল নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
গেটে সংরক্ষিত রেজিস্টারে রাতে মাঝেমধ্যে লেখা থাকত ‘অজ্ঞাতনামা নারী’। এতে আরও দেখা যায়, কোনো কর্মসূচি ছাড়াই প্রেসিডেন্ট সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট হাউস ত্যাগ করতেন এবং খুব ভোরে ফিরতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এই নিয়ম অব্যাহত রেখেছেন। প্রেসিডেন্টের রাওয়ালপিন্ডি ও করাচির ভবনে এসব ঘটত।
কমিশন বলেছে, প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব পবিত্র ধর্মগ্রন্থের আয়াত পড়ে তাঁকে (ইয়াহিয়া খান) সতর্ক করে দিলেও কোনো ফল হয়নি। ওই সময়ে গোয়েন্দা ব্যুরোর পরিচালক ছিলেন এন এ রিজভি। কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমিই একমাত্র লোক, যিনি প্রেসিডেন্টকে বলেছি আপনি অত্যন্ত উঁচু পদে আছেন, নিজের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে। আমি তাঁকে এ–ও বলেছি যে আমি বেগম সাহেবাকে অনুরোধ করেছি, আপনি যেসব জায়গায় যান, সেখানে যেন তিনি আপনার সঙ্গী হন।’
ঘটনাক্রমে ইয়াহিয়ার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নারীর সংখ্যা ছিল অনেক। তাঁদের একজন শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের গেস্টহাউসকেই নিজের বাসভবন করে ফেলেছিলেন। এক রাতে প্রেসিডেন্ট তাঁর বাসভবন থেকে উধাও হয়ে যান এবং পরে সেই গেস্টহাউসে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়।
কমিশনের অভিমত, নারী আসক্তির কারণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নিজস্ব বলয়ের বাইরে কাউকে তাঁর অফিসে ঢুকতে দিতেন না। একজন সাবেক মন্ত্রী আইন কমিশনের সামনে বলেছেন, বিশেষভাবে ডেকে আনা না হলে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেওয়ার উপায় ছিল না। তারপর কমিশন মন্তব্য করেছে, যিনি দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক প্রশাসক ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, তাঁর ব্যক্তিগত কাজে এত সময় দেওয়ার কথা নয়। আর যেসব নারী প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন।
মিসেস শামীম কে এন হোসেন ও তাঁর সাবেক স্বামী কে এন হোসেন দুজনই প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূতের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। শামীমের বাবা বিচারপতি আমিন আহমদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি। তাঁকেও ইয়াহিয়া খান জাতীয় শিপিং করপোরেশনের চেয়ারম্যান করেন; যদিও তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না।
প্রেসিডেন্টের সচিবালয়ের সচিব আবদুল কাইউমকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান টেলিফোন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই নির্দেশ দিতে বলেন যে তারা যেন টোকিওতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার জন্য নূরজাহানকে উচ্চহারে দৈনিক ভাতা দেয়। তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্যের টোকিও ভ্রমণের খরচ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হয়। বস্ত্র কারখানা স্থাপনে নাজলী বেগমকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ না দেওয়ার কারণে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদ আহমদকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
২৫ মার্চের সেনা অভিযানের পর কমিশনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ইতিমধ্যে মার্চের মাঝামাঝি চূড়ান্ত ও তিক্ত দেনদরবার শুরু হওয়ার পর মুজিব ছিলের তাঁর নিজের অবস্থানে অনড় ও অটল। তা ছাড়া যেভাবে আলোচনা ও দেনদরবার চালানো হচ্ছিল, তা যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি করে।
আলোচনা ভেঙে যাওয়া ও ২৫ মার্চের সেনা অভিযানের পর ইয়াহিয়া খান সমগ্র পাকিস্তানকে মাথায় রেখে নিজে একটি সংবিধান রচনায় উদ্যোগ নেন, যাতে তাঁর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যেদিন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, সেদিনই সংবিধান ছাপাখানায় পাঠানো হয়। ১৮ ডিসেম্বরও তিনি ঘোষণা করেন, সাংবিধানিক বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন হবে না।
আগামীকাল: পাকিস্তানি সেনাদের চুরিচামারি, ব্যবসা–বাণিজ্য
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।