ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা

করোনার মধ্যে বাড়ি যাওয়া মানে ঢাকার রোগ গ্রামে নিয়ে যাওয়া

আমরা যারা ঢাকার বাইরে থেকে এই শহরে এসেছিলাম একদিন, যারা প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে চিঠি লিখতাম, ‘পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র রচনা’ যাদের পরীক্ষার উত্তরপত্রে নয়, জীবনের খাতাতেই লিখতে হয়েছিল, তারা জানি, ঈদ মানে বাড়ি ফেরা। মা সারা রাত অপেক্ষা করেন, দরজায় একটুখানি শব্দ হলে চমকে ওঠেন, এই বুঝি ছেলে এল। এটা শুধু সারা রাতের অপেক্ষা নয়, সারা বছরের অপেক্ষা।

সারাটা বছর অনাত্মীয় নিষ্ঠুর ঢাকা শহরে কর্মব্যপদেশে কাটিয়ে বছরে দুবার বাড়ি যাব, এই তো আমাদের ধূসর জীবনে একটুখানি বাতাসের স্পর্শ, মায়াবিহীন জীবনে একটুখানি মায়ার ছোঁয়া।

একটা সময় আমার আম্মা আমাদের ভাইবোনদের ঈদে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করতেন। এখন আমরা দিন গুনছি আমাদের মেয়ে ঈদে আসবে আমেরিকা থেকে। আমাদের বাসাতে ঠিক একই প্রস্তুতি চলছে, আমার আম্মা আমার বাড়ি ফেরা নিয়ে যা যা করতেন, মিটুন পুঁটি মাছ পছন্দ করে, ওর বউ পছন্দ করে রংপুরের বিখ্যাত শিলবিলাতি আলুর খোসাসমেত ভাজি...এখন মেরিনা আমাদের মেয়ের পছন্দের খাবারগুলো বানানোর আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত...মেয়ে আসবে। আবার প্রতিটা মুহূর্তে অনিশ্চয়তা। ফ্লাইট আসতে দেবে তো!

আহ্‌! কী কষ্টটাই না করতাম আমরা পাঁচ ভাইবোন, ঢাকা থেকে রংপুরে যাওয়ার জন্য। তখন তো আমরা জানতাম না, টিকিট পেতে হয় ফোন করে, আমরা সাহ্‌রি করে একবার গাবতলীতে গিয়ে দাঁড়াতাম, আমাদের হাতে টিকিট আসার আগেই টিকিট সব বিক্রি হয়ে যেত, এরপর আমরা সারা রাত কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের লাইনে পত্রিকা বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম। তারপর হয়তো টিকিট মিলত। হয়তো মিলত না।

আরও একটু বড় হলাম যখন, তখন টিকিট পাওয়ার অব্যর্থ পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো, রংপুরে আমার ক্লাসমেটের চাচার বাস কোম্পানি আছে, আমার ভাইয়ের বন্ধু বড় রেলকর্তা...এই পদ্ধতিতে টিকিট মিলত। কিন্তু টিকিট পাওয়া মানেই পৌঁছে যাওয়া নয়। সাভার পার হতে না হতেই যানজট। সারা রাত আমরা বসে আছি কালিয়াকৈরে। কী কষ্ট কী কষ্ট! সারা রাত ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ ঘাটে বসে ছিলাম, এই দিনও তো গেছে।

এত কষ্ট মুহূর্তে মিলিয়ে যেত, রংপুরে বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে। আম্মা ছুটে আসতেন। ‘এত দেরি হলো কেন?’ তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। দেরি কেন হচ্ছে আগে থেকে জানিয়ে রাখব। একটাই উত্তর, রাস্তায় জ্যাম।

পুরা বাড়ি সরগরম। সব ভাইবোন একসঙ্গে। আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা যখন ঈদে রংপুরের বাড়িতে জড় হতো, তখন ঈদের পরের রাতে তারা আয়োজন করত আনন্দমেলা। বাচ্চাদের সেই অনুষ্ঠানে হতো প্রতিযোগিতা। তাতে থাকত আকর্ষণীয় পুরস্কার (হরলিক্স বিস্কুট, লাক্স সাবান, ফুলদানি)। সেই প্রতিযোগিতার শেষটা ঠেকত কান্নাকাটিতে। ‘আমার আব্বু কেন পারল না! এত সোজা প্রশ্ন ছিল।’

এখন আম্মা নেই। আব্বা তো কবেই মারা গেছেন। এখন আমাদের আর রংপুর যাওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু আমি জানি, কেন শত বাধা অতিক্রম করে মানুষ বাড়ি যাচ্ছেন। কারণ ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা।

এই শহরে কে আছে ওঁদের! একটুখানি জ্বর হলে কেউ দেখবে না। মরে পড়ে থাকলে আঞ্জুমান কিংবা আল-মারকাজুল ছাড়া কে দেখবে? কবর হবে কোথায়?

বাড়ি গেলে অন্তত মায়ের হাতের স্পর্শ পাব কপালে!

কিন্তু ও কথাও সত্য—করোনার মধ্যে বাড়ি যাওয়া মানে ঢাকার রোগ গ্রামে নিয়ে যাওয়া। কাজেই যে যেখানে আছি, সেখানে থাকাই ভালো।

সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, ভারত থেকে করোনার বিপজ্জনক ভাইরাস বয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু তাঁরাও আসতে চান। হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেন, ‘কেন দেবেন না ছাড়পত্র। আমরা বাড়ি যাব।’

যাঁরা বলছেন, ‘না, যে যেখানে আছেন, সেখানে থাকুন,’ আমি তাঁদের দলে। যাঁরা বলছেন, ‘যেভাবেই হোক, বাড়ি যাবই,’ আমি তাঁদের মনও বুঝি।

এবার নিয়ে তিনটা ঈদ আমরা করছি করোনাকালে। মাস্ক পরা ঈদ। ঘরে থাকার ঈদ।

সাহস করে বলতে পারছি না যে এ বছর কোরবানির ঈদ করোনার ভয়হীন পরিবেশে হবে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। ঢেউয়ের পরে ঢেউ। ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ভাইরাস এসেই গেছে। কী হবে, কে জানে।

জানি না, সামনের ঈদে কে থাকব, কে থাকব না। কিছুই বলা যায় না। তবুও ঈদ আসবে। তবুও টিভিতে যখন বাজবে, ‘ও মন রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্‌’, মনের খুশির ঢেউ জাগবেই। তখন ইচ্ছা জাগবেই প্রিয়জনের কাছে থাকার। উৎসব মানেই তো যুক্ত হওয়া। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ।

ঈদ মোবারক।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক