উইঘুর ও ফিলিস্তিনি নিপীড়নে গণনজরদারি প্রযুক্তি

জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর ও অন্যান্য তুর্কি মুসলিমের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে
ছবি: রয়টার্স

নজরদারি প্রযুক্তি দিয়ে জনসাধারণকে নিপীড়ন করা হচ্ছে। মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ প্রযুক্তির অপব্যবহারে সীমাবদ্ধ হচ্ছে মানুষের চলাচল। শান্তিকামী ভিন্নমতাবলম্বীদের যখন-তখন ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া হচ্ছে। এ বর্ণনা থেকে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর ও অন্যান্য তুর্কি মুসলিমের ওপর চীন যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, কারও মনে সেই ছবিই ভেসে উঠবে।

একই বর্ণনা ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের জন্যও প্রযোজ্য। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের নজরদারি চালানোর জন্য মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনিদের ছবি, পারিবারিক ইতিহাস ও শিক্ষা—এসব ব্যক্তিগত তথ্যের ভান্ডার গড়ে তুলেছে তারা। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেককে একটা নিরাপত্তা সূচক দেওয়া হয়। যখন সৈন্যরা তাদের স্মার্টফোনের ‘ব্লু উলফ অ্যাপ’ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মুখমণ্ডল স্ক্যান করে, তখন অ্যাপে হলুদ, লাল অথবা সবুজ চিহ্ন ভেসে ওঠে। সেই ব্যক্তিকে আটক করা হবে নাকি যেতে দেওয়া হবে, সেটার নির্দেশক এ রং।

ইসরায়েলের ব্লু উলফের মতো একই গণনজরদারি প্রযুক্তি চীন জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এটাকে ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশনস প্ল্যাটফর্ম (আইজেওপি) বলা হয়। এ প্রযুক্তি পুরো নজরদারি ব্যবস্থায় ‘মস্তিষ্ক’ হিসেবে কাজ করে। আইজেওপি আবার বড় আকারের তথ্যভান্ডার, যেটার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ বিধিবহির্ভূতভাবে কারও ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ শনাক্ত করে। কারও মুঠোফোন হঠাৎ করে ‘অফ লাইন’ হয়ে গেল কিংবা কেউ হয়তো অনেক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ফেলল—বিধিভঙ্গের কারণে সঙ্গে সঙ্গে আইজিওপিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকেত চলে যাবে। পুলিশ তখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং ‘রাজনৈতিক শিক্ষা শিবির’-এ পাঠাবে কিংবা বন্দী করবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের উদ্ভাবিত গণ-নজরদারির প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের ব্যবহার ও রপ্তানি বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য চীন একা নয়। কিছুদিন আগে ইসরায়েলের এনএসও কোম্পানির উদ্ভাবিত পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নজরদারির ঘটনা ফাঁস হয়েছে। পেগাসাস ব্যবহার করে ৪৫টি দেশের ডিভাইস হ্যাক করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ স্পাইওয়্যার কারও হাতের মুঠোফোনকেই নজরদারি যন্ত্রে পরিণত করে। এটা ফোনের ক্যামেরা, মাইক্রোফোনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।

ব্লু উলফ অ্যাপ নিয়ে প্রকাশিত সম্প্রতি একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায়। পশ্চিম তীরের বাসিন্দা একজন ফিলিস্তিনিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘আমরা কোনো সামাজিকতা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কেননা ক্যামেরা সব সময়ই আমাদের ছবি তোলে।’ একই অনুভূতি পাওয়া যাবে একজন তুর্কি মুসলিম নারীর বক্তব্যে।

এ মাসের শুরুতে ফিলিস্তিনের ছয়জন মানবাধিকারকর্মীর মুঠোফোনে পেগাসাস শনাক্ত হয়। তঁারা যেসব সংস্থায় কাজ করতেন, সেগুলোকে ইসরায়েল অন্যায়ভাবে ‘সন্ত্রাসী’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। জিনজিয়াংয়ে একইভাবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলা হয়। কর্তৃপক্ষ তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য এ কৌশল অবলম্বন করে।

জিনজিয়াং ও ফিলিস্তিন দুই ক্ষেত্রেই মানুষের অধিকারকে হরণ করার কাজে নজরদারি প্রযুক্তির অপব্যবহার করা হচ্ছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের দ্রুত শনাক্ত করে তাদের কণ্ঠরোধ করতে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১ কোটি ২০ লাখ উইঘুর কী চিন্তা করছে, তারা কী পোশাক পরছে, কাদের সঙ্গে তারা কথা বলছে-নজরদারি প্রযুক্তি ছাড়া জিনজিয়াং কর্তৃপক্ষের পক্ষে সারাক্ষণ এত খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হতো না। স্বঘোষিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলও ফিলিস্তিনিদের ওপর আধিপত্য ধরে রেখেছে নজরদারির ওপর ভিত্তি করে। তাদের বর্ণবিদ্বেষ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন ও নিপীড়নের বড় অস্ত্র এটি।

ব্লু উলফ অ্যাপ নিয়ে প্রকাশিত সম্প্রতি একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায়। পশ্চিম তীরের বাসিন্দা একজন ফিলিস্তিনিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘আমরা কোনো সামাজিকতা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কেননা ক্যামেরা সব সময়ই আমাদের ছবি তোলে।’ একই অনুভূতি পাওয়া যাবে একজন তুর্কি মুসলিম নারীর বক্তব্যে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি বলছেন, ‘লোকেরা এখানে কেউ কারও সঙ্গে দেখা করে না। যদি একজন বৃদ্ধ নারীকেও রাস্তা পার হয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে আসতে দেখি, আমরা সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাই।’

সরকারগুলো জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ও সংরক্ষণ কতটা করতে পারবে, এর প্রয়োজনীয়তা ও আইনগত ভিত্তি কী হবে, সে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োজন। এর মানে হচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি স্পষ্ট আইনি কাঠামো থাকতে হবে। সেটা ঠিকঠাকভাবে মেনে চলা হচ্ছে কি না, সেটা তদারকির জন্যও একটা স্বাধীন সংস্থা থাকতে হবে। সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক এ মানদণ্ড মেনে তাদের নিজ দেশের জন্য আইন পাস করতে হবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

  • ওমর শারিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের পরিচালক

  • মায়া ওয়াং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চীনা গবেষক