যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম ছিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। এটা নিয়ে রসিকতা করার লোভ প্রায় কেউই সংবরণ করতে পারেনি। নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো গুরুগম্ভীর পত্রিকা লিখেছিল, ৮১ বছর বয়স্ক শেক্সপিয়ারকে ‘ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল কভেন্ট্রিতে ইনজেকশন দেওয়া হয়। সেখান থেকে মাত্র ২০ মাইল উত্তরে একই নামের আরেকজনের জন্ম হয়েছিল, যিনি তাঁর চেয়ে একটু বেশি বড়, আর একটু বেশি খ্যাতিমান।’
টুইটারে এই খবর নিয়ে মজা করা হতে থাকে। ‘দ্য র্যাপ ডট কম’ নামের একটা সাইটে এ–সংক্রান্ত একটা খবর দেখছি। সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে, টেমিং দ্য ফ্লু। বলা বাহুল্য, দ্য টেমিং দ্য শ্রু নাটকের নাম থেকে এটা করা হচ্ছে। মুনীর চৌধুরী অনুবাদ করেছিলেন, মুখরা রমণী বশীকরণ।
কৌতুক বানানো হয়েছে শেক্সপিয়ারের নাটকের নামগুলো দিয়ে বা তার বিখ্যাত সংলাপগুলো দিয়ে।
নার্স: ডান হাত নাকি বাম হাত?
শেক্সপিয়ার: অ্যাজ ইউ লাইক ইট।
নার্স: ব্যথা লাগছে?
শেক্সপিয়ার: মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং
নার্স: আপনাকে আরও একটা ইনজেকশন কিন্তু নিতে হবে।
শেক্সপিয়ার: মেজার ফর মেজার।
নার্স: সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলা কেমন করল?
শেক্সপিয়ার: কমেডি অব এররস।
একটা টুইটে বলা হয়েছে তারা নাকি কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য শেক্সপিয়ারকে বেছে নিয়েছে। ঠিকই করেছে। পুরো ব্যাপারটাই তো একটা নাটক। আমাদের মনের ওপরে কাজ করবে।
বাংলাদেশে করোনার টিকা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ কিংবা কাজী নজরুল ইসলাম নামের কাউকে বেছে নেওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ টিকা নিয়ে একটা গান লিখেছেন:
‘এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা,
দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা।
মরণ আসুক চুপে পরমপ্রকাশরূপে,
সব আবরণ হোক লয়—
ঘুচুক সকল পরাজয়॥’
তবে রবীন্দ্রনাথ এখানে টিকা সম্পর্কে নির্ভুলভাবে বলতে পেরেছেন। টিকাটা হবে অগ্নিময়ী। এটা দিলে সব পরাজয় ঘুচে যাবে। কিন্তু কোথায় দিতে হবে, সে সম্পর্কে তিনি সঠিক অনুমান করতে পারেননি। টিকা তিনি দিতে বলেছেন কপালে। আসলে দিতে হবে বাহুতে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রসিকতা করলে বাঙালি তা সহ্য করে না। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর অবশ্যই প্রতিবাদ আসতে থাকবে। বলা হবে, এই টিকা আর ওই টিকা এক নয়।
তবে এই টিকা আর ওই টিকা নিয়ে রসিকতা বাংলা সাহিত্যে আগেও হয়েছে।
প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন:
‘যৌবনে দাও রাজটিকা’
‘গত মাসের সবুজপত্রে শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেছেন। আমার কোনো টিকাকার বন্ধু এই প্রস্তাবের বক্ষ্যমাণরূপ ব্যাখ্যা করেছেন—
‘যৌবনকে টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য। এস্থলে রাজটিকা অর্থ রাজা অর্থাৎ যৌবনের শাসনকর্তা কর্তৃক তাহার উপকারার্থে দত্ত যে টিকা, সেই টিকা। উক্ত পদ তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ হইয়াছে।’
আপনারা বলতে পারেন, করোনা খুব খারাপ ভাইরাস, কোভিড খুব মারাত্মক অসুখ, টিকা একটা গুরুতর ব্যাপার, টিকা কাকে দেওয়া হবে না হবে, সেটা একটা জটিল প্রশ্ন, এটা নিয়ে রসিকতা করার কী হলো?
আমি বলি, হাসুন। হাসলে পরে শরীরের উপকারী হরমোন নিঃসৃত হয়। রোগ প্রতিরোধক শক্তি বাড়ে। করোনাভাইরাস তখন আপনার কাছে এলেও সুবিধা করতে পারবে না।
দেশে যদি সত্যিকারের টিকা আসে, আর ভিভিআইপিদের যদি তা দেওয়া হয়, তাতেই বাকিরা নিরাপদ থাকতে পারবেন বলে আমার ধারণা। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করে দেখুন, শরীরে অ্যান্টিবডি পাবেন।
বড়লোকদের জন্য সুখবর আছে। ভারতে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ভ্যাকসিন ট্যুর প্যাকেজ অফার দিতে শুরু করেছে। কোনো নির্দিষ্ট দেশের টিকিট কিনলে টিকিটের সঙ্গে এক ডোজ করোনার টিকা ফ্রি।
আমরাও বলতে পারি, টিকা ফ্রি। টিকা ফ্রি।
খদ্দের এলে বলব, আমরা টাকা ফ্রি। মানে টিকামুক্ত। এখানে টিকার কোনো কারবারই নেই।
তা–ও সইবে। কিন্তু টিকার নামে বুড়িগঙ্গার পানি নিজের বাহুতে ঢোকাতে পারব না।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক