উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমের পার্থক্য কোথায়

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণির আগে কোনো প্রচলিত পরীক্ষা নেই এবং দশম শ্রেণির পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এসএসসি এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে দুটি আলাদা পরীক্ষার ফলাফল একত্র করে এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন করা হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন ২০২২ সাল থেকে শুরু হচ্ছে।

শিক্ষা মূলত তিনটি আন্তসম্পর্কিত উপাদান নিয়ে গঠিত—শিক্ষণ (টিচিং), শিখন (লার্নিং) ও মূল্যায়ন (অ্যাসেসমেন্ট)। কতটুকু ভালো শিক্ষণ ও শিখন হচ্ছে, তা মূল্যায়নের মাধ্যমে জানা যায়। এটি প্রধানত দুই ধরনের—ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন। আমাদের দেশে অনেকেই বছর বা সেমিস্টার শেষে ফাইনাল পরীক্ষাকেই মূল্যায়নের একমাত্র পথ মনে করে থাকেন, যেটা মূলত সামষ্টিক মূল্যায়ন। তবে কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাসে পারদর্শিতা, প্রকল্প, উপস্থাপনা, মধ্যবর্তী পরীক্ষা (অনানুষ্ঠানিক) ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, যেটাকে আমরা ধারাবাহিক মূল্যায়ন বলে থাকি।


উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধারাবাহিক মূল্যায়নের দিকে বেশি মনোনিবেশ করে, সেখানে আমরা সামষ্টিক পরীক্ষার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, যা মুখস্থ বিদ্যা এবং তা পরীক্ষায় বমি করার মতো খারাপ অভ্যাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে একটি যুগোপযোগী, পারফরম্যান্স-ভিত্তিক ও গঠনমূলক মূল্যায়নপদ্ধতির সুপারিশ করা হয়েছে। এখানে সামষ্টিকের চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন নেই, শতভাগ ধারাবাহিক। তবে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন নেই, এটি বলা অনুচিত। আবশ্যিক কোর্সগুলোতে চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ, নবম ও দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে, যদিও ঐচ্ছিক কোর্সগুলোতে এটা শতভাগ পর্যন্ত হতে পারে।

মূল্যায়নের আধুনিক ধারণা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা শিক্ষার্থীদের চাহিদা, যোগ্যতা, উদ্ভাবনী শিক্ষণ ও মূল্যায়ন কৌশল ইত্যাদির চেয়ে বেশি বেশি বিষয়বস্তু শেখাতে আগ্রহী। তাই প্রায়ই দেখা যায় যে শিশুদের বই ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের ওজন তাদের নিজস্ব ওজনের চেয়ে বেশি হয়, যাদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি একেবারে থাকে না বললেই চলে। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২০-এর জরিপেও বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম।

নতুন শিক্ষাক্রম পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটা স্থানীয়ভাবে ও জাতীয়ভাবে হতে পারে। সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর অতটা কার্যকর নয়, ঠিক তেমনি সনাতন মূল্যায়ন কৌশলও। একুশ শতকের দক্ষতার জন্য একুশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন।

নতুন শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের অবিলম্বে নিম্নলিখিত বিষয়ে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

১। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্কুল আব এডুকেশন বা ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন বা গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এডুকেশন রয়েছে, যারা কেবল প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক তৈরি করতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত তিনটি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে—শৈশবের শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক/উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা। উন্নত দেশে এই প্রোগ্রামগুলো সরকার সরাসরি অর্থায়ন করে, যেখানে অন্যান্য প্রোগ্রামে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর ৩০-৫০ হাজার ডলার টিউশন ফি দিতে হয়।

২। শিক্ষাসম্পর্কিত ইনস্টিটিউটগুলো প্রধানত কোর্সের বিষয়বস্তু, এমনকি সাবজেক্ট সম্পর্কে দক্ষতার পরিবর্তে উদ্ভাবনী শিক্ষণ, শিখন ও মূল্যায়নপদ্ধতির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কী শেখানোর পরিবর্তে কীভাবে শেখানো যায়, সেই বিষয়ে তারা মনোযোগ দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর মাস্টার্স প্রোগ্রামে ১৬টি কোর্স রয়েছে, যার মধ্যে ১০টি মূল কোর্স, ২টি পেশাগত অনুশীলন কোর্স ৬০ দিনের জন্য সরাসরি স্কুলে গিয়ে এবং ২টি বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য ২টি করে মোট ৪টি কোর্স নিতে হয় বিজ্ঞান, গণিত, আইটি, আর্টস ইত্যাদি এরিয়া থেকে। এ প্রোগ্রামের মূল কোর্সে শিক্ষাক্রম ও পেডাগজি-বিষয়ক ছয়টি কোর্স রয়েছে। এখন আমাদের শিক্ষকেরা তাঁদের মাস্টার্স প্রোগ্রামে যা পড়ান, তার সঙ্গে এই প্রোগ্রামের তুলনা করুন, বিস্তর পার্থক্য খুঁজে পাবেন।

৩। ধরুন, পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডিসম্পন্ন একজন গ্র্যাজুয়েটের কথা। উন্নত দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর সুযোগ তিনি কখনোই পাবেন না, যতক্ষণ না তাঁর একটি টিচিং কোয়ালিফিকেশন থাকবে, যেমন মাস্টার অব টিচিং (সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দুই মাসের অভিজ্ঞতাসহ)। বাংলাদেশে একজন গ্র্যাজুয়েট পাস করার পরপরই একজন শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পান, যা উন্নত দেশে কখনোই সম্ভব নয়। এ জন্যই আমরা শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ নিশ্চিত করতে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও বিএড বা এমএড প্রোগ্রাম আছে, কিন্তু সেগুলো বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও প্র্যাকটিসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

৪। অনেকেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কোন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট কি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক হিসেবে কাজ করবে? উন্নত দেশগুলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সম্মান ও বেতনের দিক দিয়ে অনেকাংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমান বলে মনে করে, যা বাংলাদেশে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

৫। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের পেশাদার লাইসেন্সিং ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। যেকোনো একাডেমিক অসদাচরণ, যৌন হয়রানি, পেশাদারত্ব ও নীতিশাস্ত্রের ব্যত্যয় ঘটে, এমন কার্যকলাপ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে কোনো ব্যক্তি কখনো লাইসেন্স পাবে না। ফলে যেকোনো স্তরে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার তাঁর আর সুযোগ থাকে না।

৬। প্রচলিত মূল্যায়নব্যবস্থায় শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মতোই ব্যর্থ হন। এ ব্যবস্থা তাঁদের সৃজনশীলতা ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। শিক্ষার্থীদের যেমন মূল্যায়নের প্রয়োজন হয়, তেমনি শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বিকাশের প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থী কীভাবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবেন যদি শিক্ষকের নিজেরই সে দক্ষতা না থাকে? শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক দক্ষতা অর্জন করা জরুরি, যেমন কলাবোরেশন, সহপাঠীদের মাধ্যমে শেখা, গভীর চিন্তাভাবনা ও উপযুক্ত পেডাগজি।

৭। শিক্ষার্থীরা কিছু শিখেছে কি না, তা না জেনে শেখানো অর্থহীন একটি ব্যায়াম বৈকি। আমাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে ঠিক আছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা যে পদ্ধতিতে এটি করছি, তার পরিবর্তন দরকার। যেমন শিক্ষার্থীর শেখার ইচ্ছা, ব্যবহারিকভাবে অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার, তার সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতা করার ইচ্ছা, চিন্তাভাবনায় তার দক্ষতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এ জ্ঞানের প্রয়োগ ইত্যাদি একুশ শতকে দক্ষতার এই বিষয়গুলো নিরূপণে উদ্ভাবনী ও ধারাবাহিক মূল্যায়নগুলো অনেক কার্যকর। তবে সামষ্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই দিকগুলো পরিমাপ করা কঠিন।

নতুন শিক্ষাক্রম পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটা স্থানীয়ভাবে ও জাতীয়ভাবে হতে পারে। সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর অতটা কার্যকর নয়, ঠিক তেমনি সনাতন মূল্যায়ন কৌশলও। একুশ শতকের দক্ষতার জন্য একুশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে আমি বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে ব্যাচেলর ইন আইসিটি এডুকেশন চালু করেছিলাম ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার অব টিচিং ইন ডিজিটাল এডুকেশন প্রস্তাব করেছি ২০২১ সালে। এ ধরনের প্রোগ্রামের গ্র্যাজুয়েটরা টেকনোলজি ও পেডাগজিতে সমানভাবে দক্ষ হবে এবং সর্বস্তরের শিক্ষাক্রম সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। তাই প্রোগ্রামগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়ননির্ভর প্রস্তাবিত এ শিক্ষাক্রম আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি সাহসী উদ্যোগ, কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা, ডিজাইন ও বাস্তবায়ন না করতে পারলে এটি একটি দুঃসহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পারে।

ড. মো. আকতারুজ্জামান পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি