উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ও ওষুধের পেটেন্ট নিয়ে ভাবনা

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মেধাস্বত্বের বাণিজ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন দিকবিষয়ক চুক্তি ১৯৯৪ (ট্রিপস) ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হলেও শুরুতে এটি বাস্তবায়নের জন্য উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত সদস্যদেশগুলোকে প্রাথমিকভাবে এক বছরের সময় দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে উন্নত দেশগুলোকে ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে চুক্তিটির বাস্তবায়ন করতে হয়। তবে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি অবধি ১০ বছরের অন্তর্বর্তীকাল দেওয়া হয়েছিল। অধিকন্তু, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে যেখানে বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা নেই, সেখানে ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল ও কৃষি রাসায়নিক পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্তের জন্য একচেটিয়া বিপণনের অধিকারসহ মেইলবক্স অনুসরণ করতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ একচেটিয়া বিপণনের অধিকার প্রদান করে পেটেন্ট দরখাস্তগুলো জমা রাখতে হবে এবং অন্তর্বর্তীকাল শেষ হলে পেটেন্ট দরখাস্তগুলো নিষ্পত্তি করে মঞ্জুরকৃত পেটেন্টগুলোর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা থাকা দেশগুলোর ক্ষেত্রে কোনো রোল ব্যাক প্রযোজ্য হবে না—অর্থাৎ বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা থাকা দেশগুলো তাদের আইনে পরিবর্তন এনে পেটেন্ট প্রদান বন্ধ করতে পারবে না (অনুচ্ছেদ ৭০.৮ ও ৭০.৯)।

পরে ২০০২ সালের ২৭ জুন ট্রিপস কাউন্সিল দোহা ঘোষণাপত্র ২০০১–এর প্যারাগ্রাফ ৭ উল্লেখপূর্বক স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওষুধের পেটেন্ট বাধ্যবাধকতা ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত অথবা দেশগুলো যত দিন উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ না করে—এ দুটোর মধ্যে যেটি আগে ঘটে, তত দিন পর্যন্ত শিথিল করে (ডব্লিউটিও ডক. আইপি/সি/ ২৫)। তারপর ডব্লিউটিও জেনারেল কাউন্সিলের ২০০২ সালের ৮ জুলাইয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ট্রিপসের ৭০.৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের জন্য একচেটিয়া বিপণনের অধিকার প্রদানে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বাধ্যবাধকতা ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত মার্জনা করা হয় (ডব্লিউটি/এল/৪৭৮)।

এ ছাড়া ট্রিপস কাউন্সিল ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অন্তর্বর্তীকাল ২০১৩ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি করে (ডব্লিউটিও ডক. আইপি/সি/ ৪০)। কাজেই ট্রিপস ও জেনারেল কাউন্সিলের এসব সিদ্ধান্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় যেখানে ওষুধের বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা আছে, সেখানে পেটেন্ট–ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে। তারা আইনে পরিবর্তন এনে ওষুধের পেটেন্ট প্রদান বন্ধ করতে পারবে না। আর যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ওষুধের বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা নেই, তারা দরখাস্তগুলো জমা রাখবে এবং অন্তর্বর্তীকাল শেষে দরখাস্তগুলো নিষ্পত্তি করে মঞ্জুরকৃত পেটেন্টগুলোর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেবে। তবে তাদের একচেটিয়া বিপণনের অধিকার প্রদান করতে হবে না।

অথচ বাংলাদেশে ওষুধের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দেশটির পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইতিমধ্যে দায়েরকৃত অথবা ভবিষ্যতে দায়ের করা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং কৃষি রাসায়নিক পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্তগুলোর প্রক্রিয়াজাতকরণ ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি বা পরবর্তী মেয়াদ পর্যন্ত স্থগিত করে সেগুলোকে ওই মেয়াদে মেইলবক্সে জমা রাখতে বলে এবং পরে দরখাস্তগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণে নতুন পরীক্ষার ফি দাবি করে (ডিপিডিটি/পিঅ্যান্ডডি আইন/ ২০০৭ / ৭৪ / ১২৯)। এর ফলে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্তের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ডিপিডিটির কার্যাদেশ এবং ট্রিপস ও জেনারেল কাউন্সিলের সিদ্ধান্তগুলো পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে।

পর সময়ে ২০১৩ সালের ১১ জুন ট্রিপস কাউন্সিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অন্তর্বর্তীকাল ২০২১ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত বর্ধিত করে (ডব্লিউটিও ডক. আইপি/সি/ ৬৪)। এ ছাড়া ২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর ট্রিপস কাউন্সিল আরও একটি সিদ্ধান্তে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০৩৩ সালের ১ জানুয়ারি অবধি অথবা দেশগুলো যত দিন উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ না করে—এ দুটোর মধ্যে যেটি আগে ঘটে, তত দিন পর্যন্ত ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য–সম্পর্কিত পেটেন্ট বাস্তবায়ন এবং অঘোষিত তথ্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রে ছাড় দেয় (ডব্লিউটিও ডক. আইপি/সি/ ৭৩)। ফলে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ছাড় ২০২৬ সাল পর্যন্ত চলতে পারে।

এরপর ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বরে জেনারেল কাউন্সিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্তের একচেটিয়া বিপণনের অধিকারসহ মেইলবক্স উঠিয়ে দিতে বলে (ডব্লিউটিও ডক. ডব্লিউটি/এল/ ৯৭১)। এর ফলে ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো এখন তাদের আইনগুলোকে রোল ব্যাক করাতে পারবে, অর্থাৎ দেশগুলো পেটেন্ট আইনে পরিবর্তন এনে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্ত গ্রহণ বন্ধ করতে পারবে। অথচ ডিপিডিটির বিজ্ঞপ্তিতে ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি থেকেই পেটেন্ট আইনের রোল ব্যাক করানো হয়েছে, যা ট্রিপস ও জেনারেল কাউন্সিলের সিদ্ধান্তগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর এসব কার্যাদেশের কারণে ২০০৮ সাল থেকেই বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট না দিয়ে দরখাস্তগুলো মেইলবক্সে জমা রাখা হচ্ছে, যা কেবল সে দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য ছিল, যেখানে পেটেন্ট–ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল না।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের দায়িত্ব ছিল ২০১৩ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বিদ্যমান পেটেন্ট–ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া এবং এরপর থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্ত গ্রহণ না করা। এ ছাড়া ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশসহ সব দেশের আরও দায়িত্ব ছিল একচেটিয়া বিপণনের অধিকারসহ মেইলবক্স–ব্যবস্থা একেবারেই তুলে দেওয়া। আর তা না হলে দেখা যাবে যে অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট দরখাস্ত ২০০৮ সাল থেকে বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো সেগুলোর জেনেরিক বানিয়ে দেশে-বিদেশে সরবরাহ করছে। এরপর দরখাস্তগুলোকে যখন প্রক্রিয়াজাতকরণ শেষে পেটেন্ট মঞ্জুর করে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেওয়া হবে, তখন দেখা যাবে যে বিবেচনাধীন পেটেন্টের জন্য সরকার কর্তৃক বাধ্যতামূলক লাইসেন্স জারির অনুপস্থিতিতে বহু জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি পেটেন্ট লঙ্ঘন মামলার সম্মুখীন হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের সহজতম উপায় হলো জেনারেল কাউন্সিলের ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বরের রোল ব্যাক–সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিডিটির ২০০৮ সালের বিজ্ঞপ্তিটিকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে বাতিল করা।

মো. তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।