‘উন্নয়নে’ বিপন্ন পাহাড়ি জীবন

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল নির্মাণের বিরুদ্ধে সরব স্থানীয় অধিবাসীরা
প্রথম আলো

উচ্চশিক্ষার্থে আমি যখন যুক্তরাজ্যে ছিলাম, তখন অনেক অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার এমন একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যেখানে আমি দেখতে পাই, সেখানকার একজন সাধারণ মানুষও তাদের উপনিবেশের ইতিহাসকে ইতিবাচক ও একটি গৌরবের বিষয় হিসেবে দেখে। আমার সঙ্গে এক আলোচনায় যুক্তরাজ্যের এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আমরা এখন কেমন আছি? যেহেতু তারা তাদের বৈশ্বিক সভ্যতার তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প সেই সময় শেষ করতে পারেনি, তাই আমাদের বর্তমান উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে অধীর আগ্রহী ছিল।

এখানে বলে রাখা ভালো, যুক্তরাজ্যের একটি বড় অংশ এখনো মনে করে যে উপনিবেশবাদ ছিল সারা বিশ্বকে ইউরোপীয় জ্ঞান–বিজ্ঞান ও প্রগতির ধারণা দিয়ে তাদের মতোই ‘সভ্য’ করার এক গুরুদায়িত্ব। এ নিয়ে অনেকেই আজও বেশ গর্ব বোধ করে। আজ আমার সেই অস্বস্তিকর স্মৃতিটি মনে পড়ছে, যখন দেখি আমরাও একই ধরনের উন্নয়নের বয়ান দিয়ে আমাদের দেশেরই পার্বত্য এলাকায় উন্নয়ন ধারণায় আমাদের সেই পশ্চিমা জ্ঞানের আলোকে তৈরি জ্ঞানকে চাপিয়ে দিচ্ছি, যা তাদের স্থানিক উন্নয়নের ধারণাকে বাতিল, প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা ও খারিজ করে।

দেশের পার্বত্য অঞ্চলকে সেই একই কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক জ্ঞানের ধারায় আমাদের মতো করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের সংজ্ঞা বোঝাচ্ছি এবং উন্নয়নের ডামাডোলে তাদের নিজস্ব জীবনধারার নানাবিধ পরিবর্তনকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে আসছি। উপনিবেশবাদী আধিপত্যবাদের মতোই আমরা একবারও ভাবছি না, টেকসই উন্নয়নের জন্য তাদের স্থানিক জ্ঞানের প্রয়োগ করা জরুরি বিষয়।

একটি পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়েও অধিক জরুরি একটি স্কুল বা কলেজ, যেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হতে পারে। অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তাদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে তাদের এলাকায় শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা বা সুযোগের অপ্রতুলতার কথা জোর দিয়ে বলে আসছে

একটি পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়েও অধিক জরুরি একটি স্কুল বা কলেজ, যেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হতে পারে। অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তাদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে তাদের এলাকায় শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা বা সুযোগের অপ্রতুলতার কথা জোর দিয়ে বলে আসছে। সম্প্রতি ম্রো জনগোষ্ঠীর এক ছাত্রের বক্তৃতা নিউজ ফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে তিনি বেশ জোর গলায় বলছেন, শিক্ষার অবকাঠামোর অনুপস্থিতির কথা, যা তাদের জন্য অনেক বেশি জরুরি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা থেকে ।

সেখানে কেবল পর্যটন এবং তাকে ঘিরে উন্নয়ন যেমন হোটেল ও অন্যান্য সুযোগ তৈরি করা উন্নয়নের মাঠকাঠি হিসেবে দেখা কতটা যুক্তিসঙ্গত বিষয়, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। সেই প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষাপটে আসলে উন্নয়ন কী, সেটিও বোঝা ও আমলে নেওয়া জরুরি। কেননা, নিজ সমাজের উন্নয়নের জন্য যদি তাদের বক্তব্যকে আমলে নেওয়া না হয়, তাহলে সেটিও যে কার্যকর ও টেকসই হয় না, তা আমরা নানা সময়ে দেখেছি।

এখানে আরও একটি বিষয় বিবেচ্য, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনাচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবেশর ওপর তাদের নিজস্ব নিয়মের নির্ভরশীলতা। সেখানে পরিবেশকে জীবন্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সত্তা হিসেবে দেখা হয়। আর এ কারণেই পরিবেশের ওপর নির্ভরশীলতা ও অযাচিত চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে তাদের মধ্যে সতর্ক থাকার একটি প্রবণতা দেখা যায়, যাকে আমরা তাদের প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন সংজ্ঞায়নের সঙ্গে স্থানিক জ্ঞানের একধরনের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা দেখি। সেই বিচারে উন্নয়নের সিদ্ধান্ত ও কাম্যতার বিষয়টির সঙ্গে স্থানিক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও অন্তর্ভুক্তিও উন্নয়নকে আরও বেশি টেকসই করে। এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক জীবনাচরণের সমন্বয়ের বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের বিবেচনা করা উচিত। এ প্রসঙ্গে জেমস ক্যামেরনের ‘অ্যাভাটার’ চলচ্চিত্রটির কথা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের নিবিড় সম্পর্ককে প্রতীকী অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।

ইন্ডিজেনাস নলেজ বা স্থানিক জ্ঞানের প্রয়োগের বাইরেও তাদের উন্নয়নের সাম্প্রতিক অগ্রাধিকারগুলো কী, সেটিও আমলে নেওয়া জরুরি। সেটি যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে আমরা সেই একই উপনিবেশবাদী আচরণের মাধ্যমে ইন্ডিজেনাস নলেজ বা স্থানিক জ্ঞান এবং তাদের অগ্রাধিকারগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন তো করতে পারবই না, বরং তাদের ওপর আমাদের প্রবল জ্ঞানের উন্নয়নের অ্যাজেন্ডা তাদের ওপর চাপিয়ে দিব, যা কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং একটি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের অগ্রাধিকারগুলোকে এড়িয়ে এরূপ উন্নয়ন প্রকারান্তরে তাদের প্রতিদিনকার জীবনাচরণের জন্য আরও নতুন নতুন সমস্যা বয়ে আনতে পারে। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়টি তো রয়েছেই। পর্যটন উন্নয়নের নামে বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

পর্যটনের নামে বাধাগ্রস্ত উন্নয়নের নানা উদাহরণ আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখতে পাই। পাশাপাশি পর্যটন প্রকল্পের সঙ্গে পরবর্তীকালে নানা রকম মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকি বৃদ্ধিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আমাদের মনোযোগে রাখতে হবে।

তাই যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভাবনাচিন্তার সঙ্গে তাদের চাহিদা ও অগ্রাধিকার আমলে নিয়ে স্থানিক জ্ঞানের মূল্যায়ন করা খুবই জরুরি বিষয়।

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়