উন্নয়নেও ভারতকে টপকে যাবে বাংলাদেশ, যদি দুর্নীতির লাগাম থাকে

আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি সারা বিশ্বেরও ফোকাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।
প্রথম আলো

১৪ অক্টোবর আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের মাধ্যমে ২০২০ বর্ষের জন্য বিশ্বের অনেকগুলো দেশের জিডিপির পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে। চলমান করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে, তার হিসাব অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই পূর্বাভাস সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন ও আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। আইএমএফের পূর্বাভাস দাবি করছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে ভারতীয় অর্থনীতি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নাকি মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে যাবে। ২০১৯ সালের ২ হাজার ১০০ ডলার থেকে এবার ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নেমে যাবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অতি দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ নাকি প্রায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সমর্থ হবে। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মাথাপিছু প্রাক্কলিত জিডিপি দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে। এর মানে আইএমএফ বলছে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে যাবে। এই পূর্বাভাস সারা বিশ্বে প্রবল ঝড় তুলেছে। বিশেষত, ভারতীয়দের অহমিকাপ্রসূত ‘ইগো’ এ পূর্বাভাসের ফলে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এটা তো শুধু এক বছরের করোনা মহামারির অভিঘাত নয়।

পাঁচ বছর আগেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ভারতের ১০ দশমিক ৩ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার যখন ২০২০ সালে ভারতের নমিনাল জিডিপিকে ২ হাজার ১০০ ডলার থেকে টেনে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নামিয়ে ফেলছে, তখন বাংলাদেশ যে ভারতকে টপকে যাচ্ছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! সন্দেহ নেই, আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি সারা বিশ্বেরও ফোকাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।

পাকিস্তানিরা বহুদিন ধরেই জানত, স্বাধীনতা-উত্তর ৪৯ বছরে উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। এবার যখন আইএমএফের পূর্বাভাসে মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বলা হয়েছে, তখন এই সংবাদ অনেক পাকিস্তানির কাছে নাকি আনন্দদায়ক মনে হচ্ছে। আমি নিজে অবশ্য এটা নিয়ে অতি উচ্ছ্বসিত হব না, তবে আমাদের এই সাফল্য যেন আর কখনো হারিয়ে না ফেলি, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে, পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে এখনো ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৬ হাজার ২৮৪ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫ হাজার ১৩৯ পিপিপি ডলার। অতএব ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে উঁচু। অবশ্য দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমেই অনেক কাছাকাছি পর্যায়ে চলে আসছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এ ব্যাপারে ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থানের পার্থক্য বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের কান্ট্রি-র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থান ছিল ১৩৬, আর পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ১৪৭। ভারত এই র‍্যাঙ্কিংয়ে এখনো বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে ১৩৪ নম্বরে। আগামী দু–তিন বছরের মধ্যে এই সূচকেও ভারতকে হারানোই হবে চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ২০১৮ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৪ বছর, আর পাকিস্তানের জনগণের গড় আয়ু ওই বছর ছিল ৬৬ দশমিক ৪ বছর, ভারতের ৬৮ দশমিক ৪ বছর। এর মানে স্বাস্থ্যের বিচারেও বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করছে। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ৭৩ শতাংশ, আর পাকিস্তানের সাক্ষরতার হার মাত্র ৬০ শতাংশ। মানব উন্নয়নে পাকিস্তান খারাপ করার প্রধান কারণ হলো, ৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা ও সেপাই নিয়ে পাকিস্তানের বিপুল সশস্ত্র বাহিনী পুষতে হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বোঝাটা পাকিস্তানের জন্য অসহনীয় হলেও দেশটি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় অদূর ভবিষ্যতে কমাতে পারবে না, ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পাকিস্তানের সরকার যথাযোগ্য অগ্রাধিকার দিতে পারছে না। প্রতিবছর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অথচ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যয় এখনো সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের মতো। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার।

আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিলেও ভারত অনেক এগিয়ে রয়েছে। করোনাভাইরাস আঘাত হানার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ওই বছরের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতের রপ্তানি আয় ৩১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। পাকিস্তানের রিজার্ভ মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার, আর ভারতের রিজার্ভ ৩৩০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে গত ১০ বছরের ৮ বছরই উদ্বৃত্ত ছিল, অথচ ভারতের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে মাঝেমধ্যেই ঘাটতি হচ্ছে। অন্যদিকে গত ৪৯ বছরে একবারও পাকিস্তান ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি এড়াতে পারেনি।

এর মানে গণচীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খয়রাতি অনুদান কিংবা ‘সফট লোন’ সংগ্রহ করতে না পারলে পাকিস্তানি অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। মুদ্রার বৈদেশিক বিনিময় হারে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুদ্রা ৮৫ টাকায় এখন এক ডলার পাওয়া যায়, আর ওই এক ডলার পেতে এখন পাকিস্তানে ১৫৮ রুপি লাগে। অথচ ২০০৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রুপি বাংলাদেশের টাকার চেয়ে শক্তিশালী ছিল। ভারতের রুপিও ক্রমেই অবনমনের শিকার হচ্ছে। কয়েক বছর আগে এক ডলার কিনতে ভারতীয়দের ৬৩ রুপি লাগত, এখন লাগে ৭৪ রুপি। বাংলাদেশের মোট অপরিশোধিত (outstanding) বৈদেশিক ঋণ ৩৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, অথচ পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণ ১০২ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান ছয়বার বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা ঘোষণা করেছে, অথচ বাংলাদেশ গত ৪৯ বছরে একবারও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে, অথচ পাকিস্তানে তা আজও ২ দশমিক ১ শতাংশে রয়ে গেছে। ফলে পাকিস্তান জনসংখ্যার দিক থেকে ২০০১ সালের আদমশুমারিতেই বাংলাদেশকে টপকে গেছে।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ছিল ১৬৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন, আর পাকিস্তানের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ওই বছর ছিল ২০৫ মিলিয়ন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশের টোটাল ফার্টিলিটি রেট এখন কমে ২ দশমিক ১–এ নেমে গেছে, অথচ পাকিস্তানে এই রেট এখনো ৩ দশমিক ৮ রয়ে গেছে। যেহেতু টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা মোট প্রজনন হার একজন নারী সারা জীবনে কতজন সন্তান জন্ম দেন, তার একটা পরিমাপক, তাই পাকিস্তানের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে ভবিষ্যতেও অনেক দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশ হয়তো আগামী ১০-১৫ বছরে একটা স্থিতিশীল জনসংখ্যায় পৌঁছে যাবে, যা পাকিস্তানের জন্য অচিন্তনীয়। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির দৌড়ে এখন বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থান খুবই কাছাকাছি। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি পাঞ্জাবিদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুণ্ঠন থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এই জাতির ‘অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম’ সফল করার জন্য আমাদের সুকঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে আরও বহুদিন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা আগামী বছরগুলোতে বাড়তেই থাকবে। এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে হলে এখন প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে জাতির উন্নয়নের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে।

ড. মইনুল ইসলাম, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়