‘উন্নয়নের দেহা নফার হালুরঘাডর পোল’

২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত এই সেতুটিই চট্টগ্রামের দুঃখে পরিণত হয়েছেছবি: প্রথম আলো

বড় মাছের বড় টুকরার স্বাদ নিতে নিতে হঠাৎ গলায় কাঁটা বিঁধে গেলে যে রকম হয়, ঠিক তেমনি মেগা প্রকল্পের খুশির মধ্যে কাঁটার মতো চট্টগ্রামের মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে কালুরঘাট সেতু। চট্টগ্রামের মানুষ ছড়া কেটে তাই বলেন:

রসাই রসাই মজা গরি

খাইদ্দি মাছর ঝোল

মরার কেঁডা বাজাই দিলু

হত্ত গন্ডগোল

উন্নয়নর দেহা নফার

হালুরঘাডর পোল।

(আমোদ করে, মজা করে

খাচ্ছি মাছের ঝোল

মরার কাঁটা আটকে গিয়ে

হলো যে গন্ডগোল

উন্নয়নের দেখা পায় না

কালুরঘাটের পুল)

হালুরঘাডর পোল মানে কালুরঘাটের পুল। এটিই এখন লাখ লাখ মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৩০ সালে নির্মিত ২ হাজার ১০০ ফুট দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণের পর ৯২ বছর পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে লাখ লাখ লোক এ সেতু ব্যবহার করেন। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পূর্ব পটিয়া, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম এ সেতু। চট্টগ্রামের উন্নয়নের রথে একটি মাত্র অচলায়তনের নাম এ কালুরঘাট সেতু।

গত বছরগুলোতে চট্টগ্রামের উন্নয়ন তালিকায় যুক্ত হয়েছে বড় অনেক প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, কোরীয় ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, মহেশখালী ইকোনমিক জোন, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ উড়ালসড়ক এবং চট্টগ্রাম বন্দর বে-টার্মিনাল প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। নতুন নতুন কাজ হচ্ছে একেকটা প্রকল্প একেকটা এলাকার চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। অথচ নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণে একের পর এক বাধা আসছে। এ কারণে ২০ লাখ মানুষের হতাশা দিন দিন বাড়ছে। কেননা একমুখী এ সড়কের দীর্ঘ যানজট একটা অসহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।

কর্ণফুলীর দুই পাড়ের মানুষের এ ভোগান্তি বছরের পর বছর ধরে চলছে। নিষ্ঠুর নিয়তির মতো অসহায় অবলোকন ছাড়া যেন কিছুই করার নেই। দৈর্ঘ্য অনুযায়ী এ সেতু পার হতে সময় লাগে ১০ মিনিট। কিন্তু কালুরঘাট সেতু পার হওয়ার জন্য যানবাহনগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় এক ঘণ্টার বেশি সময়। ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত এ সেতুই চট্টগ্রামের দুঃখে পরিণত হয়েছে। এরপর ২০১১ সালেও চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একদল গবেষক আরেকবার এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিলেন। এখন এই ২০২২ সালে এটি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখন সেতুর গর্তগুলো আরও বড় হয়েছে। সেই গর্ত দিয়ে নদীর পানির প্রবাহ চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কালুরঘাট সেতুর সংস্কারে আর কাজ হবে না। এ সেতু বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ, রেল কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার সাত বছর আগে ২০০৪ সালে ১১ মাস সেতুতে চলাচল বন্ধ রেখে একবার বড় ধরনের সংস্কার করেছিল। তাতে ব্যয় হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। এত বড় সংস্কারের পরও সেটি ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যায়।

কালুরঘাট সেতু প্রকল্প গ্রহণের সর্বশেষ বাধা ছিল এ উচ্চতা নির্ধারণে জটিলতা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৭ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় কালুরঘাট সেতু স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এটার উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার করার দাবি জানায়। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিআইডব্লিউটিএর কথাই রাখা হলো। বর্তমানে একটি কোরীয় কোম্পানি এ উচ্চতায় রেল কাম সড়কসেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। আগামী মে মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এরপর এটি একনেকে পেশ করা হবে। তবে কবে এ প্রকল্প পাস হবে, কখন সেতুটি নির্মিত হবে, তা অনিশ্চিত।

উন্নয়নের এ জোয়ারের সময় কালুরঘাট সেতু যেন একটা ভাটির টানের নিয়তি। অথচ এ সেতু হলে পুরো একটি জনপদের চেহারা পাল্টে যাবে। বোয়ালখালী শিল্প এলাকার প্রসার হবে। বোয়ালখালী নিজেই একটা শহরে পরিণত হবে। বহু মানুষ বোয়ালখালীতে বসবাস শুরু করবেন। তাতে শহরের ওপর চাপ কমবে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া একটি এলাকার উন্নয়নের স্বপ্ন মূলত অলীক থেকে যায়। কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন হলে বোয়ালখালীর উদালবুনিয়া সড়ক দিয়ে বান্দরবানের দূরত্ব ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার কমে যাবে। এতে করে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার সড়কের ওপর চাপ কমবে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রসারণ সার্থক হবে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নের সঙ্গে কালুরঘাট সেতু অন্তর্ভুক্ত না হলে সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক