উপমহাদেশের অভিজ্ঞতায় ইসি গঠনে নতুন ভাবনা

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর দলকে আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। তাঁর এই আহ্বানের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সূচনা হয়েছে। প্রায় সব রাজনৈতিক দলেই, বিশেষ করে বিএনপিতে সরগরম ভাব লক্ষণীয়। এর সূত্র ধরে পুরোনো প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে আসতে শুরু করেছে। কেমন হবে আগামী নির্বাচন? কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে এবং কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে এই নির্বাচন? কীভাবে গঠিত হবে নির্বাচন কমিশন? কারা থাকবেন সেই কমিশনে? কীভাবে তাঁদের খুঁজে বের করা হবে?

ওপরের প্রশ্নগুলো নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাপ বাড়ছে। বসে নেই দুর্বল ও নানা ধারায় বিভক্ত নাগরিক সমাজও। নাগরিক সমাজের প্রধান প্রশ্ন নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে, যাঁরা সাংবিধানিক দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করে থাকেন। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচনগুলোর মানদণ্ড নিয়ে ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হতাশা আছে। সার্চ কমিটি দ্বারা গঠিত দুটি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক না হওয়ায় সংস্থাটির ওপর জন-আস্থা তলানিতে ঠেকেছে। নির্বাচন কর্মকর্তারা যে পরিমাণ ভোট পড়েছে বলে ঘোষণা দেন, তার সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার মিল না থাকায় ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার বেশ কিছু নজির আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ও দৃঢ় ভূমিকার কারণে তা সম্ভব হয়েছে।

বিগত দুই নির্বাচন কেন বিতর্কিত হয়েছে এবং কীভাবে কমিশনের ওপর আস্থা ফেরানো যায়, সে বিষয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব ও কলাম লেখক আলী ইমাম মজুমদার এক কলামে লিখেছেন, নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন।

কীভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়া উচিত, তার বিধান আমাদের সংবিধানের ১১৮ ধারায় উপধারা (১)এ–তে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে এই আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের গঠিত নির্বাচন কমিশন দ্বারা ও ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল, সেটি রাজনৈতিক কারণে বাতিল হওয়ার পর যা হওয়ার তাই হয়েছে। এখন আবার (অন্তত নাগরিক সমাজ থেকে) সংবিধান মোতাবেক অর্থাৎ আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি উঠছে।

কীভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়া উচিত, তার বিধান আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে এই আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়নি।

এই উপমহাদেশে, ভারত ছাড়া ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানে সংবিধানের আলোকে প্রণীত আইনে প্রতিষ্ঠিত কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।

নেপালের সংবিধানের (২০১০)–এর আওতায় কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এর সদস্য। কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে সংসদে আলোচনা এবং গণশুনানির (পাবলিক হিয়ারিং) পর চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর প্রধান ও বাকি চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নেপালে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজনে কমিশনারদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ জনকে পরবর্তী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপরও ওই জ্যেষ্ঠ কমিশনারকেও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

এই অঞ্চলের ছোট কিন্তু ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নতুন গণতান্ত্রিক দেশ ভুটানেও সব সাংবিধানিক পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সংবিধানের আওতাধীন আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব সাংবিধানিক পদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার অন্যতম। এসব পদে নির্বাচনের জন্য একটি পর্ষদ রয়েছে। এই পর্ষদের নেতৃত্বে রয়েছেন সংসদের উচ্চ কক্ষ ন্যাশনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। পর্ষদের সদস্য হিসেবে থাকেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, নিম্ন কক্ষের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতা। এই পর্ষদ প্রাপ্ত সব নাম পর্যালোচনা করে তাঁদের নির্বাচিত নামের তালিকা ‘ড্রুক গিলারপোর’ (ভুটানের রাজা) কাছে পাঠায়। রাজার মাধ্যমে নিয়োজিত হয় নির্বাচন কমিশন। এই নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত।

পাকিস্তানের পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন অতীতে বিচারপতিনির্ভর ছিল। এখন সেখানে সাবেক আমলাদের মধ্য থেকে দুজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের নিয়োগের জন্য পার্লামেন্টে ১২ সদস্যের সংসদীয় কমিটি রয়েছে। এই সদস্যদের ৫০ শতাংশ সরকারি এবং বাকি ৫০ শতাংশ বিরোধী দলের সদস্য। প্রাথমিক নাম নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার মাধ্যমে উভয়ের সম্মতিপ্রাপ্ত নামগুলো সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার মাধ্যমে নাম চূড়ান্ত করা হয়। এরপর নিয়োগের জন্য তা প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের মধ্যে নামগুলো নিয়ে মতবিরোধ হলে দুজনের সুপারিশকৃত নামগুলো আলাদাভাবে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও সেখানে মাত্র তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হয় সংবিধানের ৩২৪ ধারা মোতাবেক। সেখানেও বাংলাদেশের মতোই নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি দ্বারা নির্বাচিত ও নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আসছে। সেখানে গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনারদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। যদিও ভারতে নির্বাচন কমিশন ও তাদের পরিচালিত নির্বাচন নিয়ে জনমনে তেমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। ইদানীং তাদের নির্বাচন কমিশন নিয়োগ পদ্ধতিও আলোচনায় এসেছে। সংবিধানের আলোকে আইন করে একটি পর্ষদের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের দাবি উঠেছে।

এক বিতর্কিত জ্যেষ্ঠ কমিশনারের সিইসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠলে একটি ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশনের’পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রুল ইস্যু করে সরকারের কাছে জানতে চান, কেন আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োজিত হবে না? এর উত্তর না পেলে সংবিধানের ধারা ৩২৫-এর আলোকে সুপ্রিম কোর্ট রুলিং দেবেন বলা হলেও, যদ্দুর জানি বিষয়টির নিষ্পত্তি এখনো হয়নি।

যাহোক, আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে ভারতের তুলনা দিয়ে থাকেন। হয়তো তাঁদের মনে থাকে না, ভারত একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, যার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনও সাংবিধানিক ও আইনিভাবে রাজ্যে প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তাদের (সিইও) দ্বারা জাতীয় এবং রাজ্যভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে। অনেকটা বিকেন্দ্রীকরণ কাঠামো ভারতের নির্বাচন কমিশনের। বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় বিকেন্দ্রীকরণের সুযোগ নেই। তা ছাড়া আমাদের দেশে সরকারি সংস্থাগুলোকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের প্রশাসন এ ক্ষেত্রে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকতে পেরেছে। ভারতের অন্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলো অনেক স্বাধীন বলে গণতান্ত্রিক বিশ্বে পরিচিত। কাজেই ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যে ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ রয়েছে, তার কারণেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে তেমন কথা ওঠে না। তারপরও আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের দাবি সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমান পদ্ধতিতে শাসক দলের প্রভাবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের পর থেকে যে বিতর্ক হচ্ছে, তা অবসানে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কমিশন গঠনে বিকল্প নেই।

স্মরণযোগ্য, ২০১১ সালে হুদা (এ টি এম শামসুল হুদা) কমিশন সর্বসম্মতিক্রমে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই সুপারিশের ওপর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও নির্বাচন কমিশন একা কোনো নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে পারে না। তবে স্বচ্ছ উপায়ে সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত কমিশন তার প্রাপ্ত ক্ষমতা প্রয়োগে অপেক্ষাকৃত জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। মনে রাখা দরকার, কমিশনের ওপর আস্থার সংকট থাকলে ওই কমিশন থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করা যায় না।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার

[email protected]