উপাচার্য আবদুস সোবহানের উচিত শিক্ষা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবাহান


লাজ-লজ্জা বলে যে একটি বিষয় আছে, সম্ভবত উপাচার্য পদে আসীন হলে তা ভুলে যেতে হয়। না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে কী কী করতে হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার পর তিনি বলেছেন, কী কারণে তারা এটি করেছেন, তা জানতে চাইবেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান সাহেব এতটাই ‘সুবোধ’ বালক যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠির মর্মার্থ বুঝতে পারছেন না। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ছিল, তাতে শিক্ষকেরা প্রশ্ন তুলেছেন কেন এখনো অভিযুক্ত রেজিস্ট্রার পদে বহাল আছেন। উপাচার্য কথার জবাব দিতে না পেরে তড়িঘড়ি করে বৈঠক মুলতবি করেছেন।
উপাচার্য মহোদয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা শিথিল করে নিজের কন্যা ও জামাতাসহ আরও অনেককে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তাই তাঁকে চিঠি দিয়ে বেআইনি নিয়োগগুলো বাতিল করতে বলেছে।
মনে আছে কয়েক মাস আগে ইউজিসির তদন্ত দল যখন অভিযোগের শুনানি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি তাদের সহযোগিতা করেননি। বরং ইউজিসির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ইউজিসি এই কাজ করতে পারেন না। আমরা অপেক্ষায় আছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শেষ পর্যন্ত আচার্যকে চ্যালেঞ্জ করে এ কথা বলেন কি না, তিনি সরকারের পরামর্শে তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন, অতএব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আচার্যের কিছু বলার নেই।

সামরিক স্বৈর শাসনের আমলে তো বটেই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের আমলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ পদে যাঁরা আসীন হন, তাঁদের অনেকে নিজেকে অসীম ক্ষমতাবান ভাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় আইনই উপাচার্যকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। বলতে গেলে তাঁর ইচ্ছায়ই বিশ্ববিদ্যালয় চলে। তাই বলে তিনি যা খুশি করতে পারেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইন, সেটি অমান্য করতে পারেন না। অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য উপাচার্য সোবহান নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করেন, উপাচার্যের বাসভবনে থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বাড়ি দখল করেছিলেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
১০ ও ১৩ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২টি চিঠি পাঠানো হয়। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। দুই দিনের ব্যবধানে একজন উপাচার্যকে ডজন খানিক চিঠি। এসব চিঠিতে নীতিমালা শিথিল করে যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তা বলা করত হয়েছে। চিঠিতে অসদাচরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি এবং নিয়োগে জড়িত সহ-উপাচার্যসহ পাঁচজন শিক্ষক, একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগ কার্যক্রমও বন্ধ রাখতে বলেছে মন্ত্রণালয়।
একটি চিঠিতে আবদুস সোবহান অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দোতলা বাড়ি দখলে রেখে ৫ লাখ ৬১ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছেন উল্লেখ করে তা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে। এসব নিয়ে প্রথম আলোয় ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম: উপাচার্যের কন্যা-জামাতার নিয়োগ বাতিলের নোটিশ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে স্পষ্ট যে উপাচার্য কেবল আইন শিথিল করে কন্যা-জামাতাকেই নিয়োগ দেননি, তিনি অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়িও দখল করে সরকারের ৫ লাখ ৬১ হাজার টাকার ক্ষতি করেছেন।

জবাবে উপাচার্য বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ স্থগিত রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে প্রশাসনিক কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণের কথা বলা হয়নি। তাই তিনি (উপাচার্য) মন্ত্রণালয়ের কাছে এই নির্দেশনার কারণ জানতে চাইবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে স্পষ্ট যে উপাচার্য কেবল আইন শিথিল করে কন্যা-জামাতাকেই নিয়োগ দেননি, তিনি অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়িও দখল করে সরকারের ৫ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।
আবদুস সোবহান ২০১৭ সালের মে থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম মেয়াদেও (২০০৯-২০১৩) তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। মাঝে এক মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন। দ্বিতীয়বার উপাচার্য হওয়ার পর আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে শিক্ষকের একাংশ প্রমাণাদিসহ অভিযোগ পাঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। তদন্তে বেশির ভাগ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন গত অক্টোবরে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়।
১৩ ডিসেম্বর উপাচার্যকে দেওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ শিথিল করে পরিবর্তিত নীতিমালা-২০১৭ অনুযায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাঁর মেয়ে সানজানা সোবহানকে টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে এবং জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজকে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন। উপাচার্যের এমন স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং শিক্ষা ও গবেষণার মান নিম্নগামী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের নীতিমালায় শিক্ষক নিয়োগের আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি বা গ্রেড পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ-৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম সিজিপিএ-৩.৫০। এ ছাড়া স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাক্রম প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। পরিবর্তিত নীতিমালায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ মোটা দাগে ৩.২৫-এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে থাকার শর্ত তুলে দেওয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বর্তমান উপাচার্যের সময়ে করা ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ১৯৭৩ সালের আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা করতে বলেছে।
মনে রাখা দরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই চিঠি পাঠায়নি। ইউজিসিও আক্রোশবশত তদন্ত করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে উপাচার্যের এসব অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা তুলে ধরে আচার্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কাছে অভিযোগ করে। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব তদন্ত ও সিদ্ধান্ত এসেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে কোটা আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন তরিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতুড়ির পিটুনিতে পা ভেঙে যাওয়ার পর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, তখন এই উপাচার্য তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে আন্দোলনকারীদের ‘বাম ঘরানার শিবির’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বা তাঁর প্রশাসনের কেউ আহত শিক্ষার্থীকে দেখতেও যাননি। কোটা আন্দোলনকারীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন বাম ঘরানার শিবির বলে। তবে ডান ঘরানার শিবির কারা সে কথাটি উপাচার্য মহোদয় সে সময় খোলসা না করলেও এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠির পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়। তাঁরা এ ঘটনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জাজনক বলে মনে করেন। তাঁরা বলেন, আত্মসম্মানবোধ থাকলে উপাচার্যের উচিত স্বেচ্ছায় এখনই পদত্যাগ করা। ব্যক্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কলঙ্কিত হতে পারে না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি