এ ওয়াই মাহফুজ আলী

শহীদ বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, রংপুর

এ ওয়াই মাহফুজ আলী

অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন রংপুরের আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলী (জররেজ মিয়া)।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকারের গণবিরোধী মানসিকতা ও পদক্ষেপের কারণে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।

পরে মওলানা ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন। আমৃত্যু এই দলের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ও তখন রংপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন।

মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন, যিনি নীতি থেকে বিচ্যুত হননি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে রংপুরে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারকার্যে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন।

উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনেও ছিল তাঁর অনন্য ভূমিকা।

২৩ মার্চ তিনি নবাবগঞ্জ বাজারে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। এদিন বিকেলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

জনসভায় ভাষণে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন করব, নয়তো মরব।’

এর আগে একাত্তরের ৩ মার্চ সকালে হাজার হাজার লোকের স্লোগানে কেঁপে ওঠে রংপুর শহর। বিরাট একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে স্টেশন রোড ধরে আলমনগর অভিমুখে যাচ্ছিল।

পথে এক অবাঙালির বাড়ি থেকে ওই মিছিলে গুলি ছোড়া হয়। গুলিবিদ্ধ হয় ১২ বছরের কিশোর শঙ্কু ও কলেজের ছাত্র শরিফুল।

ঘটনাস্থলেই শঙ্কু মারা যায়। শরিফুল গুরুতর আহত হয়। এই ঘটনায় মারমুখী হয় রংপুরের জনতা।

গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে রংপুর শহরে। সন্ধ্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরে কারফিউ জারি করে।

এভাবে চলে দুই-তিন দিন। একপর্যায়ে রংপুরের জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় নামে। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা ক্রমে বাড়তেই থাকে।


জনতার এই প্রতিবাদ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এ সময় এ ওয়াই মাহফুজ আলী প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে যান জেলা প্রশাসকের বাসভবনে।

তখন শামীম আহসান (পরে বাংলাদেশ সরকারের সচিব) ছিলেন নামেমাত্র জেলা প্রশাসক। সব ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনীর হাতে।

জনতার চাপে সেনাবাহিনী ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। তারা আশ্বাস দেয় আর গুলি করা হবে না। এরপর এ ওয়াই মাহফুজ আলী জনতাকে নিয়ে ফিরে যান।

এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ ঘটনায় তাঁকে টার্গেট করে রাখে।
২৭ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল মাহফুজ আলীকে তাঁর মুন্সিপাড়ার বাসা থেকে আটক করে রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে যায়।

সেখানে তাঁর ওপর কয়েক দিন ধরে চলে অমানবিক নির্যাতন। অবশেষে ৩ এপ্রিল আরও অনেকের সঙ্গে শ্মশানঘাটের কাছে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।


পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের হত্যা করার পর মরদেহ ফেলে রেখে চলে যায়।

পরদিন ৪ এপ্রিল এ ওয়াই মাহফুজ আলীর মরদেহ উদ্ধার করে কেরামতিয়া মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

এ ওয়াই মাহফুজ আলীর জন্ম ১৯২০ সালে, রংপুর জেলা শহরের মুন্সিপাড়ায়। বাবা এ কে মোতাহার আলী, মা আতিকা খাতুন।

রংপুর থেকে ম্যাট্রিক ও আইএ পাস করে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে এখান থেকে বিএ পাস করেন।

এরপর এলএলবি পাস করে আয়কর আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তবে রাজনীতি ও সমাজকর্মের প্রতিই ছিল তাঁর আগ্রহ ও মনোযোগ।

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির সেক্রেটারি ও রংপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।


এ ওয়াই মাহফুজ আলী ছয় ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। ছেলে এ এফ এম মকসুদ আলী, এ ওয়াই এফ মোয়াজ্জেম আলী, এ এফ এম মোরশেদ আলী, এ এফ এম মোশারফ আলী, এ এফ এম মোবারক আলী (সবাই ব্যবসায়ী) ও এ এফ এম মোকারম আলী (ব্যাংকার)।

মেয়ে রোকসানা বেগম, তাহমিনা বেগম ও তাসলিমা বেগম। তিনজনই গৃহিণী। স্ত্রী সুফিয়া খাতুন।

সূত্র: এ এফ মোয়াজ্জেম আলী (এ ওয়াই মাহফুজ আলীর ছেলে) ও ‘আমার আপনজন’, মুকুল মুস্তাফিজুর রহমান, স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]