এই দুষ্টামির অবসান কে করবে?

গৌরবের কথা দিয়েই শুরু করি। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকার রাজারবাগ আর কুমিল্লার পুলিশ লাইনে তো বটেই, খুলনা আর রাজশাহীতেও প্রথম প্রতিরোধ আমাদের পুলিশ বাহিনীই গড়ে তুলেছিল। মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে যে পুলিশ বাহিনীর এমন গৌরবের ভূমিকা, সেই পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বর্ষবরণের দিন টিএসসিতে সংঘটিত নারী লাঞ্ছনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিন-চারটা ছেলে দুষ্টামি করতাছে, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে, কেউ আগায়া আসল না, বাকি লোক তাকিয়ে দেখল। একটা লোকও তো বলল না, এই লোকটাকে তারা চেনে। তারা তাদের বাড়ির পাশের।’ (প্রথম আলো, ১৩ মে ২০১৫)।
আমরা এক মাস ধরে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে যা দেখলাম, সেসব তাহলে ‘তিন-চারটা ছেলের দুষ্টামি?’ একই বাক্যে তিনি বলছেন, ‘মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে’। তার মানে তিনি ‘মেয়েদের শ্লীলতাহানি’ করাকে ‘দুষ্টামি’ বলছেন? এরপর তিনি দায়ী করলেন বাকি লোকদের, যারা ‘তাকায়া দেখল’ অথচ বলল না সেই দুষ্ট লোকদের ‘তারা চেনে’ এবং ‘তারা তাদের পাশের বাড়ির’। অর্থাৎ সেদিন যারা ওই ঘটনার সময়ে টিএসসিতে ছিল, তাদের পাশের বাড়ির লোকজন এমন দুষ্টামি করেছে মর্মে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে এমনই প্রত্যাশা তাঁর। এরপর তিনি বললেন, ‘টিএসসির সামনে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে চার-পাঁচটি ছেলে দুই-তিনটি মেয়েকে শ্লীলতাহানি করল। যাদের সামনে এই ঘটনা ঘটাল, সেই পাবলিকরা তাদের কেন ধরল না।’ সত্যিই পাবলিক ভীষণ ‘দুষ্ট’। রান্নাঘরে আরও আছে, তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত অধিকার আছে, তাদের সামনে অপরাধ ঘটলে তারাই তাদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। এতে পুলিশের গ্রেপ্তার করা লাগত না।’ সত্যি নাকি? পাবলিক ‘গ্রেপ্তার’ও করতে পারে? তবে আর পুলিশ বাহিনীর হাতে রইল কী?
আমি ভাবতে পারি না, একটি দেশের পুলিশের মহাপরিদর্শক এমন দায়িত্বহীন, অসংলগ্ন, জেন্ডার অসংবেদী বক্তব্য দিতে পারেন!
ঘটনাটি অস্বীকার করার জন্য শুরু থেকেই পুলিশ বাহিনী যা বলছে এবং নিজেদের বক্তব্যকেই ক্রমাগত মিথ্যা প্রমাণ করে চলেছে, তা ভয়াবহ। শুরুতেই সেই ঝাড়া অস্বীকার ‘লিটন ছাড়া কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই’, ‘সিসি ক্যামেরায় কিছু বোঝা যাচ্ছে না’, ‘পুলিশের হাতে কাউকে ধরিয়ে দেওয়া হয়নি’ ইত্যাদি। রমনা জোন পুলিশের উপকমিশনার আবদুল বাতেনের চ্যালেঞ্জ মনে পড়ে, ‘এ ঘটনার কি কোনো ডকুমেন্ট আছে, না ছবি আছে?’ পরে এসআই আশরাফুল আলমের কাছে দুজনকে সোপর্দ করার কাহিনি প্রমাণিত হয়েছে এবং আশরাফুল আলমকে বরখাস্তও করা হয়েছে। ‘কিছু ঘটেনি’ থেকে ‘কিছু ঘটেছে’ স্তরে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ‘এ পর্যন্ত নারীর বস্ত্র হরণের কোনো চিত্র পাওয়া যায়নি’, আর ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘নববর্ষে বিবস্ত্রের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ সবশেষে পুরো ঘটনাকেই দুষ্টামি বললেন পুলিশের মহাপরিদর্শক। তবে কি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৫(১০) ধারাটি সম্পর্কে পড়ানো হয় না পুলিশ বাহিনীতে, যেখানে নারী নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া আছে?
এবার দেখা যাক, টিএসসির ঘটনায় তারা কী করলেন। পুলিশ ঘটনার দিনে দায়িত্ব পালনে পরিষ্কার ব্যর্থ হয়েছে, কারণ সিসিটিভিতে সবকিছু দেখে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা ছিল। দ্বিতীয় ধাপে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলল। প্রতিবাদের মুখে সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণের প্রসঙ্গ এলে দেখা গেল লিটন নন্দীসহ ছাত্র ইউনিয়নের যেসব নেতা ঘটনার দিনে উপস্থিত থেকে প্রতিরোধ করেছেন, তাঁরা গিয়ে দফায় দফায় ফুটেজ পড়ে দিয়ে এসেছেন। ফুটেজ বিশ্লেষণ করলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে কি ফুটেজ বোঝার মতো বিশেষজ্ঞ পুলিশ বাহিনীতে নেই? এখন নতুন আবদার।
তবে পুলিশ একেবারে কিছুই করেনি, এমন নয়। ১০ মে, টিএসসির ঘটনার ২৬ দিন পরে, ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি ঘেরাও কর্মসূচিতে তারা দফায় দফায় ব্যারিকেড দিয়েছে। সাঁজোয়া গাড়ি, জলকামান, অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে পুলিশ বাহিনী যুদ্ধংদেহী মূর্তিতে প্রস্তুত ছিল সকাল থেকে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পেছন থেকে সাঁজোয়া গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে। দুই দফা পেছন থেকে সাঁজোয়া গাড়ি তুলে দেওয়ার পরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ইসমত জাহান একটি ভাঙা ফুলের টব পুলিশের গাড়ির দিকে ছুড়ে মারার অপরাধে পুলিশ বাহিনী যেভাবে ‘মেরেছিস টবের কানা, তাই বলে কি ফেলে পেটাব না?’ আক্রোশে তাঁকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে, মাটিতে ফেলে নির্যাতন করেছে—তার বর্ণনা ভাষায় দেওয়া যায় না, ছবিতে সাক্ষ্য দেখি শুধু।
সব ছবিতেই দেখি ইসমতের খালি পা—যখন টবের কোনা ছুড়ে মারছেন পুলিশের গাড়ির দিকে এবং যখন পুলিশের উদ্যত বুট তাঁর দিকে—দুই ক্ষেত্রেই। একটি ছবি হাজার কথার চেয়ে শক্তিশালী। ইসমতের খালি পা বলে, পুলিশের গাড়ির দিকে টবের অংশ ছুড়ে মারার আগেই পুলিশের ধাওয়ায় খুইয়েছেন তিনি জুতো। পুলিশ তো প্রয়োজনে আটক করতে পারত। অথচ পুলিশের আক্রমণে সন্ত্রস্ত ইসমতের ছবিগুলোর সঙ্গে ২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশে তাড়া খাওয়া সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ছবির পার্থক্য কোথায়? ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেককে যেভাবে রাস্তায় ফেলে পেটানোর ছবি এসেছে গণমাধ্যমে, আর তার চারপাশে উদ্যত বুট আর বন্দুক—এসব কি বাংলাদেশের পুলিশের ছবি? নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদেরই দিকে উদ্যত পুলিশের বুট আর বন্দুক? হাসান তারেক চমৎকারভাবে বলেছেন, যতসংখ্যক পুলিশ তাঁদের ওপর সেদিন চড়াও হয়েছে, এই সংখ্যক পুলিশের সক্রিয় উপস্থিতি থাকলে টিএসসির ঘটনাটিই ঘটত না।
এত ন্যক্কারজনক ঘটনার পরে শুধু সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে পুলিশের একজন নায়েককে, অথচ প্রকাশিত ছবিতে তো আমরা ইসমতের ওপরেই চড়াও হতে দেখছি অন্তত চারজন পুলিশ সদস্যকে। এ বিষয়ে আমার আগের লেখাটিতে (অস্বীকারের রাজনীতি, প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০১৫) বলেছিলাম, টিএসসির ঘটনায় এসআই আশরাফুল আলমকে বরখাস্ত করা যথেষ্ট নয়। একইভাবে মনে করি, ১০ মের ঘটনায় একজন নায়েককে সাময়িক বরখাস্ত করা ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টামাত্র। ১০ মের ছাত্র বিক্ষোভে হামলার পরিকল্পনা কোনো নায়েক করেননি, যেমন পয়লা বৈশাখের সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় কেবল আশরাফুল আলমের নয়। পয়লা বৈশাখে টিএসসির সামনে কী ঘটছিল, সেটি সিসিটিভিতে দেখে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব ছিল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। অথচ পুলিশ প্রশাসনের প্রতিটি স্তর থেকে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যা বলছেন এবং করছেন, তারপর যখন এটিকে ব্যক্তি পুলিশের বাড়াবাড়ি বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে, সেটি মানা যাচ্ছে না। টিএসসির ঘটনায় একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত জরুরি। পাশাপাশি জানা দরকার, পুলিশ এত বেপরোয়া আচরণ কেন করছে? পুলিশ ৯ মে রাতে পিটিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক রাকিব আহমেদকে। গত বছর গার্মেন্টস শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি জানাতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফাকেও মেরেছে পুলিশ।
অথচ এ বছর ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ থানার কয়েক গজের মধ্যেই খুন হয়েছেন বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়, অভিযোগ রয়েছে আশপাশে তখন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। মার্চে খুন হয়েছেন ওয়াশিকুর রহমান। পুলিশ নয়, হত্যাকারীদের হাতেনাতে ধরেছেন তৃতীয় লিঙ্গের দুজন মানুষ। দুই দিন আগে খুন হয়েছেন সিলেটের যুক্তিবাদী লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। পুলিশ এসব ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছে?
বিশ্বাস করি, পুলিশ বাহিনীতে অনেক মেধাবী তরুণ রয়েছেন, রয়েছেন প্রাজ্ঞ দক্ষ অফিসার। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই তার কাজ। কিন্তু নানা রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে গিয়ে দায়িত্বটি উল্টে গেলে গোটা পুলিশ বাহিনী যে দুষ্টামির জন্ম দেয়, তারই ফাঁক গলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এই দুষ্টামির অবসান কে করবে?
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।