এই পাপাচারের দায় আমাদের সবার

মনোরম শারদীয় সন্ধ্যায় নববিবাহিত দম্পতি সিলেটের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। নতুন জীবন শুরু করেছেন, পৃথিবী তাঁদের চোখে রঙিন। সেই মুহূর্তে দেশের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে বধূটির জীবনে যা ঘটেছে, তা না ঘটে যদি জঙ্গল থেকে লোকালয়ে বেরিয়ে এসে হিংস্র কোনো জন্তু তার তীক্ষ্ণ দাঁত-নখ দিয়ে তাঁকে (তরুণী) ছিঁড়েফুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করত, তার চেয়েও এ ঘটনা নিষ্ঠুরতম। ঘটনাটি যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁদের প্রধান পরিচয় তাঁরা একটি ছাত্রসংগঠনের কর্মী এবং গৌণ পরিচয় তাঁরা উচ্চশিক্ষার্থী।

অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যে ছাত্রসংগঠনের দুঃসাহসী কর্মী, সেই সংগঠন ভাষা আন্দোলনে, বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে, স্বাধিকার আন্দোলনে, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে, সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলনে, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে, সেই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশেরও প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের নামের সঙ্গে যখন সেই সংগঠনের নাম উচ্চারিত হয়, তখন ওই সংগঠনের অতীতের নেতাদের মাথা হেঁট হয়।

এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ঘটনায় যাঁরা জড়িত তাঁরা যে সংগঠনের কর্মী; পঞ্চাশ, ষাট ও আশির দশকে তার অনেক নেতা-কর্মী জেল-জুলুমসহ বিভিন্ন নির্যাতন ভোগ করেছেন। আজ সেই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতে শুধু নারী নয়, দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তারা পর্যন্ত লাঞ্ছিত হচ্ছেন। তাঁদের ক্ষমতার উৎস তাঁদের সংগঠন। সে জন্যই ওই সংগঠনের বিশাল কেন্দ্রীয় কমিটিতে এমনকি ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটিতে কোনো পদে থাকার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতেও তাঁরা কার্পণ্য করেন না।

নারীর শরীরের প্রতি লালসায় এবং লাম্পট্যে কোনো সমাজের, কোনো ধর্মের, কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই পিছিয়ে নেই। তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসিডেন্ট, ইতালির প্রধানমন্ত্রী এবং ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট অনৈতিক যৌন সম্পর্কের কারণে কারাভোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের মুখোমুখি হতে হয়।

তবে বাঙালি সমাজের চিত্র অন্য রকম। যখন এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ঘটনা সংবাদ শিরোনাম, তখনই পাওয়া যায় আরও ধর্ষণের খবর। ৭ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন এক বয়স্ক পুরুষ এবং ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করেছেন ৩৪ বছরের এক যুবক। তিন-চার বছরের শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার মোদাররেস, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার যাজক কেউই নারীর প্রতি সহিংসতায় পিছিয়ে নেই। এমসি কলেজের ঘটনার পরই রাজশাহীর খ্রিষ্টানদের গির্জার ফাদার আদিবাসী এক কিশোরীকে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত ৯ মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি, তার মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২০৮টি। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৪৩টি। ধর্ষণের শিকার ১২ জন করেছে আত্মহত্যা। মিডিয়ায় যেসব খবর আসে তার ভিত্তিতেই এই তথ্য। এর বাইরে অজানা যৌন নিপীড়নের ঘটনা অসংখ্য।

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের বর্বরতার কয়েক দিন আগে ভারতের উত্তর প্রদেশে উচ্চবর্ণের চার যুবক এক দলিত তরুণীকে ধর্ষণ করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারকে না জানিয়েই তাঁর মরদেহ দাহ করে পুলিশ। ওই ঘটনায় ভারতের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে
উঠেছে। রাজপথে নেমেছেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে। আমাদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বৈকালিক বিবৃতির এক দিনের বিষয়বস্তু ছিল এমসি কলেজ হোস্টেলের ঘটনা। অন্যান্য দলও বিবৃতি দিয়েই কর্তব্য পালন করেছে। সরকারের সহযোগী ২১ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মোলায়েম ভাষায় একটি বিবৃতি দিয়েছেন। ওই বিবৃতি দেওয়া বা না-দেওয়ার পার্থক্য বোঝা যায় না। কোথাও কোথাও মানববন্ধনও হয়েছে। এখনকার মতো যদি ষাটের দশকে মানববন্ধনপ্রথা প্রচলিত হতো, তাহলে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন হতো না। একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধু অসহযোগের ডাক না দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করতেন।

বাঙালির কিছু কিছু কর্মকাণ্ড পরিহাসের মতো মনে হয়। নব্বইয়ের দশকে নারী সংগঠনগুলো মৌলভীবাজারে নূরজাহান হত্যার প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী যতটা তৎপর হয়েছিল, এখন আর তাদের উৎসাহ তেমনটি দেখা যায় না। ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের মাটিতে, ঘেরাও হলো দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন, বেইজিংয়ে বাংলাদেশের দূতাবাস। নারীর নিরাপত্তা দেওয়া এবং নারী নির্যাতন, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ প্রতিহত করার দায়িত্ব শুধু সরকার ও সরকারি দলের নয়। সমাজের অন্যদেরও।

সব কাজ যদি থানার দারোগা করবেন, তাহলে পরিবারে বাপ-মা রয়েছেন কেন? সবচেয়ে বড় দারোগা হলেন বাড়িতে মা-বাবা অথবা অন্য কোনো অভিভাবক। এমসি কলেজ হোস্টেলের ঘটনার আসামিদের জন্মদাতাদের একজন বলেছেন, ছেলেটা আগে এমন ছিল না। যাঁরা তাঁর সন্তানকে বিপথে নিয়েছেন, তাঁদেরও বিচার করতে হবে।

আসল ফাদারের শাসনের অভাবেই ছেলেমেয়ে গডফাদারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-সাংবাদিক তাঁদের এক জরিপের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। ছাত্রনেতা ও ক্যাডারদের মা-বাবার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ৯৫ ভাগ অভিভাবক তাঁদের সুযোগ্য পুত্রের ‘নেতা’ হওয়ায় গর্ববোধ করেন। অকারণে গর্ববোধ করেন না, অসচ্ছল মা-বাবা গর্বিত ছেলের যোগ্যতায়। বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে হয় না, উল্টো ছেলেই টাকা পাঠান। ঈদে ও পূজার সময় পরিবারের সবার জন্য কাপড়-জুতা-স্যান্ডেল পাঠান। বাড়ি এসে বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা কেনেন।

আসামিদের এক অভিভাবক বলেছেন, তাঁর সন্তানের অপকর্মের দায় রাজনৈতিক নেতা ও কলেজ কর্তৃপক্ষকেও নিতে হবে। তাদেরও বিচার করতে হবে। অন্যায্য কথা নয়। কলেজ বন্ধ, হোস্টেলও বন্ধ থাকবে। কিন্তু হোস্টেলের অনেক কক্ষ খোলা রইল। হোস্টেলের হেঁশেলে উপাদেয় খাবার রান্না হতে থাকল। মিডিয়ার কর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ বলেছেন, ‘সরকারি চাকরি করি, সব কথা বলা যায় না।’ তাঁর এই কথাই আসল কথা। তিনি ভুলে যাননি যে রাজশাহীতে এক শিক্ষককে তাঁর ছাত্ররা পাঁজাকোলা করে পুকুরে ছুড়ে ফেলেছিলেন।

ষাটের দশকে মোনায়েম খানের আমলে ঢাকা কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন নির্মমভাবে নিহত আওয়ামী লীগের নেতা আইভি রহমানের বাবা জালালউদ্দিন আহমদ এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন সাংবাদিক শফিক রেহমানের বাবা সাইদুর রহমান, যিনি ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুরও শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্রনেতাদের অনেকেই এই দুই অধ্যক্ষের ছাত্র। তাঁরা কেউ সরকারবিরোধী ছিলেন না, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে কর্তব্য পালন করেছেন। আজ যে পাপাচারে সমগ্র জাতি নিমজ্জিত, তার দায় একা কারও নয়, আমাদের সবার।

সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক