এই মন নিয়ে দেশ এগোবে কোথায়

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ সদরের চৌমুহনীর লোকনাথ মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তি
ছবি: প্রথম আলো

দুর্গাপূজায় অনেক বছর পর এবার নোয়াখালী গিয়েছিলাম। মাইজদী, আমাদের ছোট শহর। পাড়ায় পূজার বয়স ৭২ বছর। খুব সাধারণভাবেই পূজার আয়োজন হয়। কোনো বড় পৃষ্ঠপোষকতা নেই। সবার সাধ্যমতো সামান্য টাকায় পাঁচ দিনের পূজার আয়োজন।এটুকুতেই পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। গান, নাচ, আরতি—সব হতে থাকে একের পর এক। পুরো পাড়া আক্ষরিক অর্থেই হয়ে ওঠে একটি পরিবার। এমনই অন্তরঙ্গ প্রাণের যোগ।

আমি এ–বাড়ি ও–বাড়ি ঘুরে কাকিমা, পিসিমা, জেঠিমাদের সঙ্গে দেখা করি, প্রণাম করি, মিষ্টিমুখ হয়। আমাদেরও বয়স হচ্ছে, আর প্রণাম করার মানুষও কমে আসছে। এবার তাই ভেবেছিলাম, যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করে সময়টুকু কাটাব। কে জানে, আগামী বছরে আর কারও সঙ্গে দেখা হয় কি না–হয়!

কিন্তু এই আনন্দের মধ্যে ছায়া পড়ে গেল। মা যেদিন এলেন, তার পরদিন সপ্তমী থেকেই শুরু হয়ে গেল আতঙ্ক। কুমিল্লায় কোন এক দুর্বৃত্ত কী করেছে, সেই থেকে শুরু হলো গন্ডগোল। আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে গেল সবখানে। প্রশাসনের কাছে সাহায্য চাওয়া হলো। এলেন দুজন পুলিশ। কয়েক ঘণ্টা থেকে মধ্যরাতে চলে গেলেন তাঁরা। আমার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র আর তাদের বন্ধুরা সারা রাত পাহারা দিল দুর্গা প্রতিমাকে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর ব্যাংক রোডে হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত রাধামাধব জিওর মন্দির
ছবি: প্রথম আলো

সপ্তমীর সন্ধ্যায় পূজামণ্ডপে দাঁড়িয়ে আমি আরতি দেখছিলাম। আর অপরিসীম বেদনা নিয়ে শুধু অনুভব করছিলাম, আনন্দের মধ্যে কীভাবে বিষ ঢুকে যায়। ওরা পাহারা দিচ্ছে। সবার ভেতরে ভয় আর সন্দেহ। অচেনা কাউকে দেখলেই অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে উঠছে। তিন তরুণ মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করেছেন, পরিবেশটা বদলে গেল মুহূর্তে। সবার মধ্যে সংশয় আর টানটান উত্তেজনা। কিন্তু না, তরুণেরা নিজেদের মতো করে কিছুক্ষণ পূজা দেখে চলে গেলেন।

নবমীর রাতে খবর এল, নোয়াখালীর রাজগঞ্জে প্রতিমা আক্রান্ত হয়েছে। রামগতিতে চরসীতার মন্দিরেও। আমার ছোট ভাই এবার পাড়ার পূজা কমিটির সভাপতি। পরের দিন শুক্রবার আবার কিছু হয় কি না, সেই ভয়ে নবমীর রাতেই সে সিদ্ধান্ত নিল, পাড়ার সামনের পূজার গেট তুলে নেওয়া হোক, খুলে ফেলা হোক আলোকসজ্জা।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর ব্যাংক রোডে হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত রাধামাধব জিওর মন্দির
ছবি: প্রথম আলো

১৫ অক্টোবর, শুক্রবার। দশমীর দুপুরে আমি ঘরে। হঠাৎ চিৎকার। বাইরে বেরিয়ে দেখি, দুপুরে নামাজ শেষে মানুষের একটি জটলা আমাদের পাড়ার সামনে দিয়ে মিছিল করে যাচ্ছে। আমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখে একটি বড় গেট আছে। সেই গেটে তালা মারা হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় সেটি ছিল না। বছর দুই আগে নতুন এই ব্যবস্থাপনা। যা হোক, পাড়ার ছেলেরা সবাই গলিতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। পাড়ার সামনের চলমান মিছিলটা বাইরে থেকে কিছুক্ষণ ঢোকার চেষ্টা করল। ঢুকতে না পেরে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়ল। একসময় চলে গেল।

নিমেষে পুরো পাড়া শ্মশান। সবার মধ্যে এখন দুশ্চিন্তা, দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন কীভাবে হবে? পাড়ার ভেতরে একটি পুকুর ছিল, কিছুদিন আগে সেটি বিক্রি করে দেওয়ার পর সেই পুকুরটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। পাড়ার পেছনের দিকে আরেকটি পুকুর আছে, সেখানে বিসর্জন দেওয়া যায়। কিন্তু সেই পুকুরে যাওয়ার পথটা একেবারেই সংকীর্ণ।
আমার ভাই বলল, সকাল থেকে পিকআপ ভাড়া করার জন্য চেষ্টা চলছে, কিন্তু ভয়ে কেউ আসতে চাচ্ছে না। সে সময়ই খবর এল, চৌমুহনীতে মন্দিরে ভাঙচুর চলছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর ব্যাংক রোডে হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত রাধামাধব জিওর মন্দির
ছবি: প্রথম আলো

কোনো প্রতিমাই রেহাই পাচ্ছে না। সঙ্গে চলছে লুটপাট—হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের দোকানপাট আর বাড়িঘর সর্বত্র। পাড়ার গেটে তালা দিয়ে দুরুদুরু বুকে আমরা সবাই ঘরবন্দী। চৌমুহনী থেকে ভিডিও পাঠাচ্ছে বন্ধুরা। ভিডিওগুলো দেখে সবার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের ছোট ছেলের তো কান্নার সীমা–পরিসীমা নেই। শুনলাম, আমাদের চেনা একজন মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রীও গুরুতরভাবে জখম।
আমার মনে হচ্ছিল, যেন একাত্তর ফিরে এসেছে। ১৯৭১ সালে আমার বাবা ভারতে যাননি। আমাদের পুরো পরিবার এই বাড়িতেই মৃত্যুভয়ে এভাবে তটস্থ হয়ে কাটিয়েছিলাম।

খোঁজ নিয়ে জানতে পেলাম, প্রশাসন থেকে বলার মতো কোনো সাহায্য পাঠানো হয়নি। মাইজদী পুলিশ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে তো পুলিশ কম নেই। ফেনীতেও বিজিবির মূল অফিস। খোলা আকাশের নিচে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চলল। ততক্ষণে সব তছনছ। রামঠাকুরের সমাধি আশ্রম ভেঙেচুরে গেল। অথচ বাবরি মসজিদের দুর্ঘটনার সময়ে সেখানে ফুলের টোকাও পড়েনি। কত পরিবার টাকা, অলংকার আর সারা জীবনের সম্বল হারিয়ে পথে বসে গেল।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে গত শুক্রবার হিন্দুদের মন্দির, দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে হামলা হয়। হামলায় দুজন ইসকন–ভক্ত নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসকন–ভক্তসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। গত শনিবার দুপুরে চৌমুহনীর রেলগেটের পূর্বপাশে
ছবি: প্রথম আলো

ঘর, দোকান বা মন্দির ভেঙেছে, সেসব হয়তো গড়ে উঠবে আবার; কিন্তু এতজন মানুষের মন যে চুরমার হয়ে গেল, তার কী হবে!

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে গত শুক্রবার জুমার পর বিক্ষোভ মিছিল থেকে হামলা-ভাঙচুর চলাকালে দুটি প্রাইভেট কারে অগ্নিসংযোগ করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের প্রতিমা বিসর্জন তখনো হয়নি। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় উঠল। নোয়াখালী শহরের বিদ্যুৎ চলে গেল। আমার ভাইয়ের চেষ্টা কোনোমতে সফল হলো। ওর এক বন্ধু পিকআপ নিয়ে হাজির। চোরের মতো ভয়ে ভয়ে পিকআপে দুর্গাপ্রতিমা তুলে অন্ধকারে পেছনের পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হলো।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে গত শুক্রবার জুমার পর বিক্ষোভ মিছিল থেকে হামলা-ভাঙচুর চলাকালে দুটি প্রাইভেট কারে অগ্নিসংযোগ করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

আতঙ্ক আর অপরাধীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে নিজের দেশে ধর্মীয় উৎসব উদ্‌যাপন করলাম। এত ধুমধামে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করা বাংলাদেশের এটাই কি উত্তরাধিকার? এই বর্তমানকেই কি আমরা মেনে নেব আমাদের ভবিষ্যৎ বলে? ধরে নেওয়া যাক, একদিন সব সংখ্যালঘু চলেই গেল দেশ ছেড়ে। তবে এই মনটা তো থেকে যাবে দেশেরই মধ্যে। সে দেশ নিয়ে আমরা কোথায় এগোব? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সময় আমাদের এসেছে।

ড. মালবিকা সরকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক