এক কোটি পরিবার চাইলেই জোগাতে পারে আরেক কোটি পরিবারের খাবার

চলমান লকডাউনে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে সাহায্য সময়মতো না পৌঁছালে অনেককেই না খেয়ে থাকতে হবে

করোনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝাটা খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষকেই বহন করতে হচ্ছে বেশি। মধ্যবিত্ত আজ নিম্নবিত্ত আর দরিদ্র-হতদরিদ্র হয়ে গেছে। আর হতদরিদ্রের অবস্থা তো অকহতব্য। চলমান লকডাউনে খেটে খাওয়া এসব মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য সময়মতো না পৌঁছালে অনেককেই অভুক্ত থাকতে হবে।

সরকার হয়তো এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের জানামতে, সরকারের আর্থিক সামর্থ্যেরও ঘাটতি নেই। আর যদি থেকে থাকেও, বিকল্প উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করা যায়। যেমন ধরুন, সব সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঈদের বোনাস থেকে কিছু টাকা কর্তন করা যায়। প্রথম, দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বোনাস থেকে যথাক্রমে ২০, ১০ ও ৫ শতাংশ হারে অর্থ কর্তন করা যেতে পারে। আরও প্রয়োজন হলে বেতন-ভাতা থেকেও কর্তন করা যেতে পারে। মন্ত্রী এবং সাংসদদের ভাতার একটা বড় অংশও তো নিয়মিতভাবেই কর্তন করা যেতে পারে। আর তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কেনাকাটা বা খরচ থেকে অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ তো সব সময়ই থাকে। তাই অর্থ সংস্থান বিষয়ে সরকারের তেমন কোনো দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়।

সঠিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাঁদের কাছে সময়মতো সরকারি সাহায্য পাঠানোই হলো মূল চ্যালেঞ্জ। দুর্বল স্থানীয় সরকারকাঠামো দিয়ে সঠিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির কথা না হয় বাদই দিলাম। তাই বিকল্প ভাবতে হবে। সাহায্য সর্বজনীন করা একটা ভালো বিকল্প, কিন্তু সরকারের আর্থিক সামর্থ্যে তা কুলাবে না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এনজিওর মাধ্যমে দ্রুত একটা তালিকা করা যায়।

আবহমানকাল থেকেই সামাজিক পুঁজি আমাদের একটা বড় শক্তি। মানুষের আপদ-বিপদ থেকে শুরু করে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সামাজিক পুঁজিতেই গড়ে উঠেছে। কালে কালে সেই সামাজিক পুঁজির শক্তি হয়তো ক্ষয়ে গেছে, তবে একবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। প্রমাণ গত বছরের লকডাউন। সেই সময় অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন ও ব্যক্তি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও এই সামাজিক পুঁজির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কিন্তু এ বছর করোনার ভয়াবহতার তীব্রতা শতগুণ বেশি হলেও লকডাউনের তৃতীয় সপ্তাহে এসে রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক—কোনো মহলেরই তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাহলে কি আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে? তা নিশ্চয়ই নয়। করোনাকাল দীর্ঘ হওয়াতে সামর্থ্য ও উদ্যমে কিছুটা ভাটা পড়েছে, পড়াটাই স্বাভাবিক। কথায় আছে, নিত্য বিপদে কে কার সঙ্গী। গত এক বছরে করোনার জাঁতাকলে বেশির ভাগ মানুষের উপার্জনই কমেছে। তা ছাড়া রোজা চলছে, সামনে ঈদ। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের হৃদয়বান মানুষদের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হয়তো একটু সময় লাগছে। তবে আমরা জানি একবার কেউ বেরিয়ে এলে অনেকেই বেরিয়ে আসবে।

বাংলাদেশে কমবেশি প্রায় চার কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে হয়তো এক কোটি পরিবারের আশু খাদ্য সাহায্য দরকার। এক কোটির এখন না লাগলেও লকডাউন অব্যাহত থাকলে লাগবে। বাকি দুই কোটির মধ্যে এক কোটির হয়তো অন্যকে সাহায্য দেওয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা নেই। কিন্তু তারপরও যে এক কোটি পরিবার থাকে, প্রতিটির প্রতিদিন একটি করে পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার সামর্থ্য আছে। এই এক কোটি পরিবারের প্রতিটিই আগামী এক মাসের জন্য যদি একটি পরিবারের খাবারের দায়িত্ব নেয়, তাহলে দেশে কেউ অভুক্ত থাকবে না। আর এক মাসের খাদ্যসহায়তার জন্য প্রতিটি পরিবারের খরচ হবে ১০ হাজার টাকা। এই টাকা অনেক পরিবারেরই ফিতরা বা জাকাতের অর্থের সমান। আর কোনো কোনো পরিবারের জন্য এটা তো অতি সামান্য টাকা।

ধর্মের দোহাই না হয় না-ই দিলাম। এখন তো বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত যে পরোপকারে মানুষের কর্মশক্তি এবং কর্মস্পৃহা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, যার ইতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার আয়-রোজগারের ওপরও পড়ে। মোট কথা, রমজানের সংযম থেকেই হোক, কি বৈশাখী উৎসবের বেঁচে যাওয়া অর্থ থেকেই হোক অথবা ঈদের খরচ কাটছাঁট করেই হোক, ১০ হাজার টাকা জোগাড় করা সচ্ছল এক কোটি পরিবারে পক্ষে কষ্টকর কিছু নয়। আমাদের বিশ্বাস, প্রতিটি পরিবারেরই এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার সদিচ্ছাও আছে। ইচ্ছাটাকে শুধু কাজে পরিণত করা দরকার। তাই আসুন আমরা আমাদের সংযমের অর্থটুকু গরিব আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীর হাতে তুলে দিয়ে তাদের অভুক্ত অবস্থার পরিত্রাণ ঘটাই।

তবে হ্যাঁ, দীর্ঘদিন ধরে হয়তো কোনো সমাজের পক্ষে এ ধরনের দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তবে সরকারি সাহায্য আসার আগপর্যন্ত তো এটা আমরা চালিয়ে যেতেই পারি। আর সরকারি সাহায্য আসার পর যেখানে ঘাটতি থাকবে, সেখানে এই সাহায্য অব্যাহত থাকলে কাউকে অন্তত না খেয়ে থাকতে হবে না।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়