এক কোরিয়ার জন্য অপেক্ষা আর কত দিন?

ডিমিলেটারাইজ জোন, এই পাশে দক্ষিণ কোরিয়া ওই পাশে উত্তর কোরিয়া
রয়টার্স

কোরীয় যুদ্ধের ৭০ বছর পূর্তি হলো এ বছরের জুনে। সেই যুদ্ধের আগেই সে সময়ের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল এই উপদ্বীপটিকে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, স্নায়ুযুদ্ধের সেই হিসাব-নিকাশও আর নেই। দুই ভিয়েতনাম এক হয়েছে, দুই জার্মানি এক হয়েছে কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপ এখনো বিভক্ত। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধ শেষও হয়নি। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন দক্ষিণ কোরিয়ায় উত্তর কোরিয়ায় আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের শুরু হয়েছিল, তার ঠিক তিন বছরে মাথায় সংঘাত থেমেছিল একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধ অবসানে স্থায়ী কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। ৭০ বছর ধরে সেভাবেই চলছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবাদিক সমিতি (জেএকে) বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে তাঁদের দেশে নিয়মিত একটি বিশ্ব সম্মেলনের (ওয়ার্ল্ড জার্নালিস্ট কনফারেন্স বা ডব্লিউজেসি) আয়োজন করে। ২০১৪ সালের জুনে এমন একটি আয়োজনে যোগ দিয়েছিলাম। এর ঠিক ৬ বছর পর ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর এই সম্মেলনটিতে আবার যোগ দেওয়ার সুযোগ হলো। তবে এবার ভার্চ্যুয়ালি।

২০১৪ সালের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর থেকে কোরীয় উপদ্বীপ, দুই কোরিয়া, এর বিভক্তি, দুই কোরিয়ার এক হওয়ার সম্ভাবনা, এর ভূরাজনৈতিক দিক—এসব নিয়ে আগ্রহ জন্মায়। বিশেষ করে দুই কোরিয়াকে ভাগ করেছে যেই সীমান্ত, সেখানকার ডিমিলেটারাইজ জোন (ডিএমজেড) ঘোরার অভিজ্ঞতা এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল; বিশ্ব রাজনীতি কীভাবে একটি দেশের জনগণকে ভাগ করেছে এবং বছরের পর বছর ধরে তা টিকিয়ে রেখেছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে জাপানের দখলে থাকা কোরীয় উপদ্বীপকে দুই পরাশক্তি চুক্তি করে ভাগ করে ফেলে, যেখানে কোরীয় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোনো বিবেচনার বিষয় ছিল না।  

উত্তর কোরিয়া দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক দেশ। দেশটির জনগণ কী চান বা তাঁদের চিন্তাভাবনা আসলে কী, সেটা জানার সুযোগ আমাদের বিশ্ববাসীর নেই। দুই কোরিয়া এক হোক, এই আকাঙ্ক্ষা তাঁদের মধ্যে কতটা তীব্র কে জানে! কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপের বিভক্তি ঘোচাতে দক্ষিণ কোরিয়া ও এর জনগণের স্বপ্ন যে কতটা গভীর, ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ডব্লিউজেসিতে যোগ দিয়ে তা টের পেয়েছিলাম। সেই সম্মেলনের মূল থিম ছিল ‘কোরীয় উপদ্বীপের শান্তি ও দুই কোরিয়ার একত্রকরণ’। এবারের ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে একটি দিনের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘কোরীয় যুদ্ধের ৭০ বছর এবং কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির নীতি’। গত সম্মেলন থেকে ফিরে একটি লেখা লিখেছিলাম, ‘দুই কোরিয়া, এক হওয়ার স্বপ্ন’ শিরোনামে (প্রথম আলো, ২৬ জুন, ২০১৪)। এরপর ছয় বছর গেল, কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠা, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও একত্রকরণের পথে কিছু এগুলো কি?

উত্তর কোরিয়া দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক দেশ। দেশটির জনগণ কী চান বা তাঁদের চিন্তাভাবনা আসলে কী, সেটা জানার সুযোগ আমাদের বিশ্ববাসীর নেই। দুই কোরিয়া এক হোক, এই আকাঙ্ক্ষা তাঁদের মধ্যে কতটা তীব্র কে জানে! কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপের বিভক্তি ঘোচাতে দক্ষিণ কোরিয়া ও এর জনগণের স্বপ্ন যে কতটা গভীর, ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ডব্লিউজেসিতে যোগ দিয়ে তা টের পেয়েছিলাম।

২০১৮ সালে দুই কোরিয়ার সীমান্তে শান্তির গ্রাম হিসেবে পরিচিত পানমুনজমে বৈঠকে বসেছিলেন উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং-উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। সেই বৈঠক থেকে ‘শান্তি, সমৃদ্ধি ও কোরীয় উপদ্বীপের পুনরেকত্রীকরণের’ জন্য পানমুনজম ঘোষণা এসেছিল। কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য দুই পক্ষ একসঙ্গে কাজ করতেও তখন একমত হয়েছিল। এর আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে দুই কোরিয়ার একক দল হিসেবে অংশ নিয়েছিল নারী আইস হকির দলটি। দুই কোরিয়ার খেলোয়াড়দের নিয়ে দলটি গড়া হয়েছিল।

আর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হিসেবে গত ছয় বছরে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তিন দফা দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে দুটি শীর্ষ সম্মেলন ও দুই কোরিয়ার সীমান্তে পানমুনজম গ্রামে দুই নেতার সাক্ষাৎ। উত্তর কোরিয়ার মাটিতে পানমুনজম গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পা রেখে ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়েছেন।

গত ছয় বছরে যা ঘটেছে তার মধ্যে অনেক কিছুই ছিল অভাবিত। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হলো? দুই কোরিয়ার মধ্যে ২০১৮ সালে যে তিনটি বৈঠক হয়েছে তা আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এখন থেমে আছে। কারণ ট্রাম্প-উন আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোনো পরিণতি পায়নি। বলা যায়, উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি না হওয়ায় দুই কোরিয়ার মধ্যেও সমঝোতা এগোচ্ছে না।

বিশ্ব সাংবাদিক সম্মেলনে কোরীয় যুদ্ধের ৭০ বছর ও শান্তির পথ নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে সেখানে হাজির ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার দুই বিশেষজ্ঞ—কোয়িংনাম ইউনিভার্সিটির ফার ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক ইউল-চুল লিম ও সিউলের থিংকট্যাংক ইওসিজের গবেষণা সহযোগী ও উত্তর কোরিয়া স্টাডিজে পিএইচডি সন তায়েক ওয়াং। অধ্যাপক লিমের মতে, উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতার অভাবই কোরীয় উপদ্বীপের শান্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তিনি মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার চাওয়া মৌলিক সমাধান। অবরোধ দেশটির জনগণ ও উন্নয়নকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে, তারা সেই অবরোধ প্রত্যাহার চায়। অবরোধ উঠিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তারা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ নেবে না।

এমন একটি অবস্থায় অধ্যাপক লিম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু উদ্যোগ আশা করেন, যার মধ্য রয়েছে পিয়ং ইয়ং-ওয়াশিংটনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ, উত্তর কোরিয়ায় মানবিক সাহায্য প্রবেশের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া ও দেশটিতে মার্কিন নাগরিকদের ভ্রমণে বিধিনিষেধ শিথিল করা। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার উচিত পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা বন্ধ করা, কোরীয় যুদ্ধের সময় আটক এবং এখনো বেঁচে আছেন, এমন যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া। অধ্যাপক লিমের বক্তব্য অনুযায়ী, কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠা বা দুই কোরিয়ার এক হওয়ার প্রক্রিয়ার অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের ওপর।

তবে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে সক্রিয় অন্য পক্ষগুলোর ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ আছে কি? বিশেষ করে চীন, জাপান বা রাশিয়ার মতো দেশগুলোকে। উত্তর কোরিয়া তখনই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে রাজি হতে পারে, যখন তারা মনে করবে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। কোরীয় উপদ্বীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলেই এটা সম্ভব। কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি শুধু দক্ষিণ কোরিয়া নয়, জাপানেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া—দুটি দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপ দখলকারী জাপানের ব্যাপারে কোরীয় জনগণের রয়েছে ঐতিহাসিক অস্বস্তি। কোরীয়দের কাছে জাপান এক দখলদার শক্তি। দুই দেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক শত্রুতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একটি শক্তিশালী ও একক কোরিয়া জাপান আদৌ দেখতে চাইবে কি না, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।

উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সীমান্তের দৈর্ঘ্য খুবই ছোট কিন্তু দেশ দুটির ভূখণ্ড দিয়ে যুক্ত। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। সীমান্ত দিয়ে যুক্ত কোরীয় উপদ্বীপের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে রাশিয়ার অবস্থানকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ ও প্রভাব বিস্তারে প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। সামনের দিনগুলোতে এটা আরও বাড়বে বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দেশটিকে চীনের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আদৌ তা হাতছাড়া করার ঝুঁকি নেবে কি? অন্যদিকে অবরোধে বিপর্যস্ত ও দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়া টিকে আছে মূলত চীনের সমর্থন ও সহায়তায়। দুই কোরিয়ার এক হওয়ার উদ্যোগের অর্থই হচ্ছে কোরীয় উপদ্বীপে নিজেদের প্রভাব হারানো। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কোরীয় জনগণের এক কোরিয়ার স্বপ্ন পূরণে এত বড় ছাড় দেবে কি?

দক্ষিণ কোরীয় বিশ্লেষক সন তায়েক ওয়াং মনে করেন, কোরীয় উপদ্বীপ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের বিষয়টি বেশ জটিল। তিনি এ জন্য বৈশ্বিক জনমত গঠনের গঠনের কথা বলেছেন। সাংবাদিকেরা যে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে সেটা তিনি সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন।

কোরীয় জনগণের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দুই কোরিয়া এক হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন শুধু তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না। কিন্তু বিশ্বের যেকোনো শান্তিকামী মানুষেরই বোঝার কথা কোরীয় উপদ্বীপের বিভক্তির রেখা মুছে ফেলা কতটা জরুরি। এই বিভক্তি বড় করুণ ও বেদনার। লাখ লাখ মানুষকে তা পরিবার বিচ্ছিন্ন করেছে। গত ৭০ বছরে বহু কোরীয় এই কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। আর এখনো যুদ্ধের ভীতির মধ্যেই বাস করতে হচ্ছে তাদের।
কোরীয় জনগণকে আর কত অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]