এক ভয়ার্ত সাঁওতালপল্লি থেকে বলছি...

অনি​শ্চয়তার মুখে এ রকমই থতমত সমতলের আদিবাসীরা
অনি​শ্চয়তার মুখে এ রকমই থতমত সমতলের আদিবাসীরা

মেয়েটির নাম অনীতা—অনীতা হেমব্রম। বাড়ির দাওয়ার মাটির থামের আড়াল থেকে লজ্জায় মুখ বের করতেই পারছিল না। তাদের উঠানের গাছের ডালিম সবুজাভ হলুদ, দেয়ালে আলপনা আঁকা; কেমন এক শান্তি শান্তি পরিবেশ। অনীতার প্রিয় তৃষ্ণার্ত কাকের গল্প, প্রিয় কবিতার নাম ‘শোভা’, প্রিয় গান ‘আমার সোনার বাংলা’। অথচ সোনার বাংলার বাঙালিরাই তাদের বিপদের সর্বনাম।
সবার চোখের জলই সমান নোনা, সবার রক্তই সমান লাল। কিন্তু তা হয়তো নয়। উত্তরবঙ্গের পার্বতীপুরের গহিন মেঠোপথের মাথায় যে গ্রামটির নাম চিড়াকুটা, সেখানকার মানুষের সবই কম। তাদের জমি কম, রক্ত কম লাল, চোখের পানি কম নোনা, অত্যাচার-নির্যাতনও যেন তাদের গা-সওয়া। কমই যদি না হবে, তাহলে এত সহ্য করে কীভাবে? বাঙালির পক্ষে বাঙালি, মুসলমানের ডাক আরেক মুসলমানে শোনে, হিন্দু ও খ্রিষ্টানদেরও সহায়-শক্তি আছে এ দেশে—কিন্তু আদিবাসী সাঁওতালদের কিছুই নেই। চিড়াকুটার সাঁওতাল উচ্ছেদ হলে শিমুলজুড়ির সাঁওতালেরা তাদের আশ্রয় দিতে ভয় পায়। এত ‘নেই’-এর মধ্যেও খুব করে ‘আছে’ তাদের গায়ের রং, চেহারার ধাঁচ আর সাঁওতালি ভাষার বুলি। এই থাকাতেই মস্ত বিপদ। হোটেল-রেস্তোরাঁয় তাদের পাতে কেউ খায় না। তাদের কোনো যুবকের স্বজাতির বাইরের কাউকে ভালোবাসা মানে মৃত্যু ডেকে আনা। তাদের মর্যাদা ও সম্পত্তি দুটোই যেন লুটপাটের বিষয়।
এ বছরের ২৪ জানুয়ারির ঘটনা। সকালবেলা চিড়াকুটার কৃষকেরা তাঁদের জমিতে গিয়ে দেখেন, পাশের গ্রামের জনৈক জিয়ারুল-জহুরুল ভ্রাতৃদ্বয় লোকজন নিয়ে হাল চষা শুরু করেছেন। বাধা দিলে তাঁদের একজন পিস্তল বের করেন। সাঁওতালি রক্তে সুপ্ত হুলের স্মৃতি জেগে ওঠে। সাঁওতালি তিরে এক বাঙালির প্রাণ যায়। যথারীতি পুলিশ এসে ২৩ সাঁওতালকে আটক করে। পুলিশ যাওয়ামাত্রই চারপাশের হাজার হাজার বাঙালি মুসলমান নামধারী হামলাকারী ‘পিঁপড়ার মতো আসি’ ঘরদোর লুট করে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, ছিনিয়ে নেয় গবাদিপশুসহ অস্থাবর সব সম্পদ। তারপরও অটুট তাদের অপার্থিব সরলতা, সাঁওতালি ঐক্য আর আধুনিক হাহাকার।
এর প্রায় পাঁচ মাস পর ১ জুলাই চিড়াকুটায় গিয়ে পেলাম মধ্যবয়সী চ্যালচিউস হেমব্রমকে। কথা বলতে বলতে উত্তেজনায় তড়পাচ্ছিলেন। বলছিলেন ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর নেতা সিধো-কানো-চাঁদ-ভৈরব ভাই ও তাঁদের ফুলমণি বোনের কথা। কিন্তু যেই বললাম, ‘আপনারা তো সংখ্যায় কম, পারবেন কী করে?’ বাতাস–হারা পতাকা যেমন মিইয়ে পড়ে, লোকটার গলার স্বরও তেমনি নেমে যায়: ‘ওদিকে ভারত এদিকে বাংলাদেশ, কী করব, কোথায় যাব? সংখ্যায় তো আমরা কম! আমারও মারবা ইচ্ছা করে, কিন্তু পারি না!’
পার্বতীপুর থেকে রওনা দিলে মোটরসাইকেলে দুই ঘণ্টার পথ চিড়াকুটা। পথের মধ্যে অবিরত সবুজের সমারোহ, বৃষ্টিভেজা খেতগুলো ধান রোপার জন্য প্রস্তুত। মাটির বা পাকা রাস্তার ওপর ধানের খড় আর ভুট্টা শুকাতে দেওয়া। বৃষ্টিজমা খেতে বা খালে বাচ্চা-বুড়ো মাছ ধরছে। কোথাও কোনো বিপর্যয়ের চিহ্ন নেই। শুধু চিড়াকুটা গ্রামের জমিগুলো ফাঁকা, চাষবাস বন্ধ। পুরো গ্রামে সরকারি স্কুলঘরে পুলিশ ক্যাম্প। আরও এগোলে সাঁওতালপল্লির মাটির ঘরবাড়ি। পাঁচ মাস আগের আগুনের দাগ এখনো এদিকে-ওদিকে। কয়েকটি অঙ্গার হওয়া গাছ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাঙাচোরা টিনের বেড়া, চালহীন কিছু ঘর সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাঁচ মাসেও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। সেদিনের পর এলিজাবেথ টুডুর রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। দুঃস্বপ্নের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে সেদিনের হামলার স্মৃতি।
মধ্যবয়সী বিমলা মুর্মুর চোখে এখনো ভাসে সেই সব দৃশ্য: ‘হিসাব ছাড়া লোক আসছে সেদিন আমার ঘরে। আমার দুই ড্রাম চাল, টিভি, সাইকেল, সেলাই মেশিন, হাঁড়িকুড়ি, জামা-কাপড়—সব নিয়ে গেছে।’ গ্রামের মধ্যে এটিই সবচেয়ে অবস্থাপন্ন বাড়ি। গ্রামের একমাত্র টেলিভিশনটাও তাদেরই ছিল। বিমলার দুঃখ, ‘সেলাই মেশিন আমার জান, সেটাও নিয়ে গেল! তারা আমার পায়ে বাড়ি দিল, গলায় টিপে ধরে কোমরে হাত দিয়ে মোবাইল নিতে গেল। আমি দৌড় দিলাম—এত পুরুষ আমার পেছনে। কেউ বলতেছে ম্যারা ফেল। তখন লালমাটি গ্রামের মোস্তফা চৌকিদার আমারে বাঁচাইল! কিন্তু মোবাইল আর পাইলাম না।’
৬৫ বছরের বৃদ্ধ লক্ষণ টুডুর হাহাকার লুট হওয়া পোয়াতি গরুটার জন্য। ‘এত দিনে গরুটা মনে হয় বিয়াইছে’ বলে হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করতে থাকেন। মেসেস টুডুর বিমারি স্বামী জেলখানায়, বাড়িটা মাটির সঙ্গে মেশানো, ওর মধ্যেই ছিল তাঁর খাসি বিক্রির ১০ হাজার টাকা—তা–ও পুড়েছে। ওদের ধারণা, এখন যারা গ্রাম পাহারা দিচ্ছে তারা তাদের পুলিশ, আর যারা গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে গেছে তারা ‘ওদের পুলিশ’। ওদের ধারণা, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের ব্যাপার আর সিধো-কানো সংস্কৃতির ব্যাপার।’ ওদের ধারণা, ‘যা বলব সত্যই বলব, মিথ্যা বলব কেন?’ ওদের ধারণা, বউ পেটানো ছাড়া আর কোনো অপরাধ তারা করে না। ওরা মনে করে, সাঁওতালদের মধ্যে কানা-খোঁড়া, চোর-ডাকাত-ভিখারি কিছু নাই। ওদের ধারণা, মারামারি-লুটপাট করলে ‘নিজের জাতের ওপরই ঘিন্না লাগবে!’ ওদের বিশ্বাস, ‘আমরা জয় পাব, কারণ সরেজমিনে লড়াই করছি, আর ওরা তো ভূমিদস্যু।’
অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঁওতালেরা পাকিস্তানি মিলিটারি হটিয়ে রংপুরকে অল্প সময়ের জন্য স্বাধীন করেছিল। কিছুদিন আগেও গ্রামে ফুটবল খেলা হলে সাঁওতাল-বাঙালি মিলেমিশে ‘লাফাত’। জাত নিয়ে ছি ছি করত না! কিন্তু মাঝখানে চলে এসেছে ভূমি। সেই ইংরেজ আমল থেকে জমির অধিকার, অরণ্যের অধিকার, মর্যাদার অধিকার বাঁচাতে সাঁওতালেরা লড়ে যাচ্ছে।

দুই.
আগের দিন ছিল ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বছরপূর্তি। এ উপলক্ষে দিনাজপুর শহরে জমায়েত হয়েছিল কয়েক হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষ-শিশু। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে বাসে করে, ভটভটিতে চড়ে তারা এসেছে রোদে পুড়তে পুড়তে। এর আয়োজন করে আদিবাসী পরিষদ ও দিনাজপুরের নাগরিক সমাজ। তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। সবার দাবি, সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন হোক। সেখানে যতজনের সঙ্গে কথা বলেছি, অধিকাংশেরই জমি নিয়ে হয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, নয়তো এলাকার প্রভাবশালী বাঙালিদের সঙ্গে বিরোধ চলছে। কোথাও সরকারের বন বিভাগ তাদের জমিকে বনাঞ্চল ঘোষণা করে দখলে নিচ্ছে। দিনাজপুরের হাজী দানেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পাটকলসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই সাঁওতালদের জমির ওপর নির্মিত।
এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী তাঁদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দাবি করলেন, ৮০ শতাংশ সাঁওতালি জমি নিয়েই গন্ডগোল চলছে। চিড়াকুটার যে ৪৩ একর ৩৩ শতক জমি নিয়ে বিবাদ, তার ১৯ একর ১৭ শতক জমিতে অনাদিকাল থেকে সাঁওতালেরাই চাষবাস করছিল। কিন্তু বিষয়বুদ্ধি নেই বলে, আর শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে এসব জমির দলিল-রেকর্ড তারা করে উঠতে পারেনি। আর পারলেই-বা কী, ভূমি দপ্তর, সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে নকল দলিলের ভিত্তিতে সেই সব জমি কেড়ে নেওয়া খুবই সহজ। আমেরিকায় একসময় স্বর্ণ শিকারিরা গোল্ড রাশের জন্ম দিয়েছিল, বাংলাদেশে এখন চলছে ভূমিদস্যুদের ল্যান্ড রাশ তথা ভূমিগ্রাসের ছিনিমিনি খেলা। এই খেলায় সাঁওতাল-আদিবাসীসহ প্রান্তিক হিন্দু-মুসলমান বাঙালির জেতার সম্ভাবনা খুবই কম।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা নিরসনে একটা ভূমি কমিশন সরকার গঠন করেছে। অনুরূপ কমিশন সাঁওতালদেরও দাবি। এর জন্য আইন লাগবে, লাগবে ভূমি প্রশাসনের দুর্নীতি বন্ধ করা। কিন্তু কে করবে?

তিন.
দিনাজপুর থেকে পার্বতীপুরে যাওয়ার পথে এক স্কুলের মাঠে দুজন মানুষকে ঘুরে ঘুরে ঢোল আর মাদল বাজাতে দেখে থামি। মাঠের প্রান্তে সাদা কাপড়ের প্যান্ডেলে প্রমাণ আকারের দুই যোদ্ধামূর্তি। হাতে তির-ধনুক আর পুরু গোঁফ দেখে চিনতে পারি, সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক সিধো ও কানোর মূর্তি। পাশেই আদিবাসী কমিউনিটি সেন্টার। সেখানকার মণ্ডপে প্রতি সন্ধ্যায় বাতি দেওয়া হয়, ঢোল-মাদলের নাচে আর পুষ্পে সাঁওতালদের জাতীয় বীরদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। মাঠের দুই পাশে বালক ও বালিকাদের জন্য আলাদা দুটি বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় ও কমিউনিটি সেন্টারের এত জমি কোথা থেকে এল? জটলার ভেতর থেকে জবাব দিলেন হাড্ডিসার প্রৌঢ় একজন। হাসতে হাসতে বুকে হাত দিয়ে বললেন, ‘আমি দিসি।’
অবাক চোখে লুঙ্গি-শার্ট পরা ছোটখাটো মানুষটার ফোকলা মুখটায় তাকিয়ে থাকি।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ঢোল-মাদল নিয়ে ওরা উঠে দাঁড়াল। কোথায় যায়? বলে, নসিপুরে এক বাড়িতে বিয়া। সেখানে বাজনা বাজাব, নাচব। আর কী করব?
হারিয়ে ফেলার আগেই এই আদিবাসী দাতা হাতেম তাইয়ের নাম জানতে চাইলাম। আকাশি রঙের শার্টের বুক পকেটের কাছটায় আবারও হাত দিয়ে মানুষটা উত্তর করে, ‘আমার দাদা ডুলু মুর্মু, বাবা মঙ্গল মুর্মু আর আমি নরেশ মুর্মু। এই সব জমি আমাদের দান।’
এখন কত জমি আছে আপনার?
চলে যাওয়ার আগে অবলীলায় হা হা হা হেসে লোকটা বলে, ‘কিসসু নাই।’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]