একজন রসগ্রাহীর বিদায়

ফারুক চৌধুরী নামে মানুষটির কীভাবে বর্ণনা দেওয়া সম্ভব? দীর্ঘ পেশাদার জীবন কাটানো সফল একজন কূটনীতিক। ১৯৫৬ সালে, পাকিস্তান আমলে, যোগ দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরে। পরাধীনতার সেই যুগ থেকে স্বাধীনতার যুগে এসে, ১৯৯২ সালে, শেষ হয় তাঁর কূটনীতিক জীবন। মাঝখানের এই ৩৬ বছর বহু গুরুত্বপূর্ণ এবং কখনো কখনো স্পর্শকাতর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাঁকে। কর্মব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন ইতালি, চীন, নেদারল্যান্ডস, আলজেরিয়া ও যুক্তরাজ্যে। রাষ্ট্রদূত হিসেবে দেশের মুখপাত্র হয়ে গেছেন আবুধাবি, বেলজিয়াম ও ভারতে। ১৯৮৪ সালে উঠেছিলেন পেশার সর্বোচ্চ চূড়ায়, হয়েছিলেন পররাষ্ট্রসচিব। কিন্তু কর্মজীবনের এই তালিকায় ফারুক চৌধুরী কোথায়?

অবিভক্ত ভারতে, আজকের বাংলাদেশের সীমানার ওপারে, আসামের করিমগঞ্জে ফারুক চৌধুরীর জন্ম হয়েছিল—তাঁর ভাষায় রাজা ‘পঞ্চম জর্জের অনুগত প্রজা হিসেবে’। দিনটি ছিল ১৯৩৪ সালের ৪ জানুয়ারি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে-পরে আসাম ও সিলেটে স্কুল বদল করেছেন পাঁচবার। এরপর ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে স্নাতক। পড়াশোনা শেষ করার পরপরই সুপিরিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে ঢুকে গেলেন আমলা-জীবনে। এও নিছক এক জীবনপঞ্জি।

ফারুক চৌধুরীর মূল পরিচয় সম্ভবত এই যে তিনি ছিলেন একজন রসগ্রাহী। জীবনকে তিনি উপভোগ করেছেন নানা দিক থেকে। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গ, সাহিত্যের সজীব ভুবন, দেশে দেশে বিচরণ এবং বিশ্বজুড়ে ছড়ানো অভূতপূর্ব খাদ্যের আস্বাদে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর ব্যক্তিত্বকে স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল করে তুলেছিল। স্নিগ্ধতা ও রসবোধ তাঁর সংস্পর্শে আসা মানুষদের গভীরভাবে স্পর্শ করত। নির্মল রসবোধে বিষণ্ন মুহূর্তও তিনি লঘু করে তুলতে পারতেন। যেকোনো মানুষকে কাছে টেনে আনতে এবং অন্তরঙ্গ সম্পর্কে বেঁধে ফেলতে তাঁর জুড়ি ছিল না। দেশে-বিদেশে ও বিচিত্র ক্ষেত্রে ছড়ানো বন্ধুদের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তিনি জীবন পার করেছেন।

জীবনকে বিস্তৃত পরিসরে দেখার ও বরণ করার মনটি তিনি পেয়েছিলেন উপমহাদেশের উত্থান-পতনময় ইতিহাস ও পেশাজীবনে বিচিত্র লোকের সান্নিধ্য থেকে। নিজের জীবনের পটভূমি রচনা করতে গিয়ে জীবনের বালুকাবেলায় নামে আত্মস্মৃতিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের ইতিহাসের একটি অসাধারণ এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায়েই জীবন কাটিয়েছি—তিন পতাকার নিচে; অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান আর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে। পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায়।’

তাঁর কৈশোরবেলা থেকে পেশাজীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত এ উপমহাদেশের ইতিহাসের ওপর দিয়ে কী ঝঞ্ঝামুখর ঝোড়ো হাওয়াই না বয়ে গেল। বিলয় ঘটল ব্রিটিশ উপনিবেশের, পাকিস্তান থেকে অভ্যুদয় হলো নবীন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। রাজনীতির বহু নায়ক পরিণত হলো খলনায়কে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন বহু রাষ্ট্রনায়ক। এ রকম বহু ঘটনা তিনি দেখেছেন বেশ কাছ থেকে। দেখেছেন ঘটনার কুশীলবদের।

দেশে-বিদেশে বড় বড় মানুষের ছক কাটা চেহারার আড়ালে দেখেছেন তাঁদের চকিত মানবিক মুহূর্ত। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ধর্মান্তরিত স্ত্রী রানা লিয়াকতের উদারতা ও শেষ জীবনের নিঃসঙ্গ বিষণ্নতা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি বুমেদিয়ানের দক্ষতা, বেলজিয়ামের রাজা বঁদোয়াকে রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশ করার সময়কার হাস্যপরিহাসময় ঘটনা, প্রিন্স চার্লসের হাস্যরস, মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর উপস্থিত বুদ্ধি, ঢাকার সার্ক সম্মেলনে কাশ্মীরের বিতর্কিত সীমান্তচিহ্নিত ডাকটিকিট নিয়ে রাজীব গান্ধী-জিয়াউল হককে নিয়ে উত্তেজনাময় প্রহর—এমন অসংখ্য ঘটনার অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা তাঁর অভিজ্ঞতাকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু ঘটনার ভালোমন্দ ছাপিয়ে বেশির ভাগ সময় তিনি বুঝতে চেয়েছেন তাঁদের মানুষী সত্তা।

ফারুক চৌধুরীর বড় গুণ ছিল তাঁর ইতিবাচক মন। সেখানে তিক্ততা ছিল না। রাজনীতির নায়ক বা খলনায়ক যাঁর প্রসঙ্গেই তিনি উত্থাপন করুন না কেন, প্রথমেই তাঁকে ভালো বা মন্দের সাদায়-কালোর খোপের দিকে তাঁকে ঠেলে দিতেন না। ইতিহাসের চরিত্র হিসেবে ইতিহাসের পটে রেখে তিনি তাঁদের বিচার করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সাহচর্যে নামিয়ে আনতেন মানুষের বৃত্তে। তাঁর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছত্র ধার করে বলতে হয়, তাঁর জীবনের মর্মবাণী ছিল, ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’

মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি দিল্লিতে। বঙ্গবন্ধুর ভারত আগমন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনার তিনি নিকটতম সাক্ষী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকার যাত্রাপথে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার সুযোগও ঘটেছিল। ফারুক চৌধুরী বিবেচনায় এই পুরো ঘটনা ছিল তাঁর কূটনীতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। সে স্মৃতি তিনি নানাভাবে লিখেছেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তখনো মুজিবশূন্য। তিনি তখনো পাকিস্তানি কারাগারে অন্তরীণ। কবে মুক্তি পাবেন, তা অনিশ্চিত। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মত গড়ে তুলতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে ভারত সফরে গিয়েছেন তাঁরা। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের সময় অকস্মাৎ সম্মেলন কক্ষের দরজাটি সশব্দে খুলে ভেতরে ঢুকলেন ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত। উত্তেজিত কণ্ঠে জানালেন, এইমাত্র খবর এসেছে, বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন।

অবশেষে ব্রিটিশ বিমানে করে সে সময়ের ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এসে নামলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ফারুক চৌধুরী আবেগময় ভাষায় দিয়েছেন সে মুহূর্তের অভূতপূর্ব বর্ণনা: ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি গিরি, ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দুপাশের জনতা।...স্বাধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি।’

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি উপমহাদেশের আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মঞ্চ হিসেবে সার্কের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ফারুক চৌধুরী তখন পররাষ্ট্রসচিব। সার্ক প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতাটিকেও তিনি অমূল্য বলে ভাবতেন। নানা টানাপোড়েনে সার্কের সম্ভাবনা যে অর্থবহ হতে পারল না, সে নিয়ে তাঁর দুঃখবোধ ছিল।

খাদ্য ছিল ফারুক চৌধুরীর অনন্য বিলাসের উপাদান। যেমন দেশি খাদ্য, তেমনই দেশ-বিদেশের। প্রথম আলোর অনুরোধে কতবার যে রান্না নিয়ে লিখেছেন। দিয়েছেন বিচিত্র সব খাদ্যের রেসিপি। কথায় তুলতেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের খাদ্যের প্রসঙ্গ—ভুটানের কাঁচা মরিচের সঙ্গে রাঁধা ঝাল পনির; কাশ্মীরের গুজতাবা, ইয়াখনি, রোগন জোশ; বাগদাদের মাসগুফ; চীনের মাওতাই, রোমে গালিয়াজ্জি রেস্তোরাঁর মুরগির কাচ্চাতোরে এবং আরও কত কী!

প্রথম আলোর সঙ্গে ফারুক চৌধুরীর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। ওসামা বিন লাদেন ও তালেবান-শাসিত আফগানিস্তান নিয়ে উত্তেজনাকর সময়ে প্রথম আলোর হয়ে তিনি পাকিস্তানে গিয়েছিলেন সাংবাদিকতার দায়িত্ব নিয়ে। সেটি পালনও করেছিলেন অসামান্য দক্ষতায়। পুরোনো বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি অবলীলায় প্রশাসনের উচ্চমহলে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন।

যে আনন্দ ও রঙে তিনি আমাদের ভরে দিয়ে গেছেন, তার মধ্যে ফারুক চৌধুরী বেঁচে থাকবেন।

সাজ্জাদ শরিফ: কবি ও সাংবাদিক।