একজন 'বাংলাদেশি বিদেশির' কথা

আজ থেকে বছর দশেক আগে ঈদ ও বড়দিন কাছাকাছি সময়ে পড়ত। মানুষ নিজেদের পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের এ উপলক্ষে নানা উপহার দেয়, এ দৃশ্য দেখে প্রাণটা সত্যিই জুড়িয়ে যায়।এই দেওয়ার সঙ্গে জাকাতের সম্পর্ক আছে—মানে আমার জানামতে, বছরে একবার মোট আয়ের ২ দশমিক ৫ শতাংশ চরম দরিদ্র মানুষ ও এতিমদের জন্য দান করা (নগদ, সঞ্চয় ও গয়না)। বাংলাদেশে একজন বিদেশি হিসেবে আমি বড়দিন ও ঈদের মধ্যে অনেক মিল দেখতে পাই—এ দিন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা একে অপরের বাড়িতে যায়, বিশেষ বিশেষ খাবার রান্না হয়, যাদের কিছুই নেই বললেই চলে, তাদের জন্য কিছু করা প্রভৃতি।
২০০৪ সালে বাংলাদেশে আমার কাজ ছিল সরকারি একটি প্রকল্পের অধীনে সবচেয়ে দরিদ্র্য মানুষদের সহায়তা করা। এ প্রকল্পের নাম ছিল আদর্শ গ্রাম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এর কাজ ছিল গ্রামের গৃহহীন ও ভূমিহীন দরিদ্র মানুষদের ঘর তৈরি করে দেওয়া। বিশেষত, নদীভাঙা মানুষদের এ প্রকল্পে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হতো। এ রকম একটি প্রকল্প পরিচালনায় নানা প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক ঝক্কি পোহাতে হয়, তবু সেখান থেকে যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছিলাম, তা ছিল অমূল্য ও অসাধারণ। পরে ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমি চরম দরিদ্র মানুষদের নিয়ে কাজ করি। ডিএফআইডি ও অস্ট্রেলিয়া এইডের অর্থায়নে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চর লাইভলিহুড কর্মসূচির আওতায় আমরা এ কাজ করেছি।
আদর্শ গ্রামে কাজ করার সময় আমাকে প্রতিদিন বনানীর আরামদায়ক ফ্ল্যাট থেকে নীলক্ষেত যেতে হতো। যাওয়া ও আসায় দুবার হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও অতিক্রম করতে হতো। অধিকাংশ দিনই এ হোটেলের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকার সময় দুটি প্রতিবন্ধী বাচ্চা মেয়ে ফুল বা ছোট ছোট তোয়ালে নিয়ে হাসিমুখে আমার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াত। তারা এসব বিক্রি করে টাকা আয় করত। তারা একভাবে আমার পরিবার ও নৈমিত্তিক জীবনের অংশ হয়ে যায়। ঈদের দিন তাদের হাতে নতুন কাপড় তুলে দিতে পারার আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। ওদের বাবা মাকে ছেড়ে চলে গেছে। ওদের মায়ের দোষ হচ্ছে সে শুধু মেয়েরই জন্ম দেয়নি, সে বিকলাঙ্গ মেয়ের জন্ম দিয়েছে। মেয়ে দুটি খুবই নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে থাকত, তাদের হাসিমুখ দেখে হৃদয়ে একঝাঁক ময়ূর পেখম মেলে নাচতে শুরু করে।
হৃদয়ের এ স্বতোৎসারিত কথামালায় কোনো যুক্তিপরম্পরা না পেয়ে পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন। ১০ বছর আগে আমি ঢাকা স্টেজের প্রযোজনায় চার্লস ডিকেন্সের এ ক্রিস্টমাস ক্যারোল নাটকের চারটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। এটা একটা আপতিক ঘটনাই বটে। এটি ১৮৪৩ সালের বড়দিন উপলক্ষে প্রথম প্রকাশিত হয়। ডিকেন্স খুব দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন, বইটি সে অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই তিনি লিখেছেন। ঋণের কারণে ডিকেন্সের বাবার কারাদণ্ড হলে তাঁর মা তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে একটি জুতা পলিশের কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেন, সেখানে তিনি সপ্তাহে ছয় শিলিং আয় করতেন। বইটি যখন লেখা হয়, ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ড তখনো দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত হয়নি, শিশুমৃত্যুর হারও তখন বেশি, ১৮৭৫ সালে সুয়ারেজ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে প্রায়ই কলেরার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যেত।
ক্রিস্টমাস ক্যারোলের গল্প একজন ব্যবসায়ীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, তার নাম এবেনেজার স্ক্রুজ। সে ছিল ভীষণ কৃপণ। কোনো কিছুর প্রতিই তার কোনো খেয়াল ছিল না। মানবতা শুধু টাকাওয়ালাদের ক্ষেত্রেই খাটে, তা সে টাকা শোষণ বা ভয়ভীতি প্রদর্শন যেভাবেই আয় করা হোক না কেন। সে বিশেষভাবে বড়দিনকে ঘৃণা করত। বছরের এ সময়টা এলে ‘নিজের বয়স তার এক বছর বেশি মনে হয়, নিজেকে একপ্রস্থ বেশি ধনী মনে হয় না।’ বড়দিনের প্রাক্কালে তার সাবেক অংশীদার জ্যাকব মার্লের ভূত এসে তার সামনে আবির্ভূত হয়। সে সাত বছর আগে বড়দিনের প্রাক্কালে মারা গিয়েছিল।
মারলে স্ক্রুজের মতোই কিপটে, সে এখন পারলৌকিক জীবনের ঝক্কি পোহাচ্ছে। সে চায় স্ক্রুজকে যেন তার মতো ভাগ্য বরণ করতে না হয়। সে স্ক্রুজকে বলে, তিনটি আত্মা তার পিছু নেবে। এই তিনটি আত্মা হচ্ছে বড়দিনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভূত। এই তিনটি ভূত স্ক্রুজকে তার ভুল বুঝতে সহায়তা করে। তারপর তার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা যায়, বড়দিনের দিন সে তার দীর্ঘদিনের কেরানি বেচারা বব ক্র্যাটচিটের কাছে ক্রিসমাসের উপহার পাঠায়, বড়দিনের সকালটা তার ভাতিজা ফ্রেডের সঙ্গে কাটায়, যাকে সে আগে অবজ্ঞা করত। স্ক্রুজ তার নবলব্ধ উদারতায় বলীয়ান হয়ে ক্র্যাটচিটের বেতন বাড়িয়ে দেয়, তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। এমনকি ববের বিকলাঙ্গ পুত্র টিনি টিমের দেখভালও সে করবে বলে জানায়। শেষে ডিকেন্স বলেন, ‘স্ক্রুজ সেই ভালো মানুষ, ভালো কর্তা ও বন্ধু¬ হয়ে যায়, সেই পুরোনো শহর যেমনটা জানত।’
বড়দিনের ছুটি সম্পর্কে ডিকেন্স যে বিবরণ দিয়েছেন, সেটাই এ রকম উৎসবের মাহাত্ম্য হওয়া উচিত।
‘ভালো সময়: দয়ালু, ক্ষমাশীল, পরহিতকর, সুখী সময়। বছরের শুধু এ সময়েই নর-নারী নিজেদের হৃদয়ের কপাট খুলে দেয়। এ সময় তাঁরা সমাজের নিচুতলার মানুষদের কথাও ভাবেন, যাঁরা তাঁদের কবরযাত্রার সহগামী, ভিন্ন কোনো পথের যাত্রী তাঁরা নন। উৎসব লোভী বাণিজ্যের মুনাফা কামানোর উপলক্ষ নয়, এটা মানুষের হৃদয়ের ব্যাপার।’
বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই ১৯৭১ সাল থেকে, ফলে আমার অনেক বন্ধুই আমাকে ‘বাংলাদেশি বিদেশি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। আমি বিশ্বাস করি, আমার হৃদয়ের এই স্বতোৎসারণ অন্যদের হৃদয়ের তন্ত্রীতেও মানবতার সুর তুলবে—তাঁরা শুধু এ রকম উৎসবের দিনেই সমাজে যাঁদের কম আছে, তাঁদের কাছে যাবেন বা সহানুভূতি দেখাবেন না, বছরজুড়েই তাঁরা সেটা করবেন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: ২০১২ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন।