একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেশিশক্তি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেশিশক্তি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমাদের কিছু শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চড়াও হচ্ছিল দেখে আমাদের সমাবেশ শহীদ মিনার থেকে নেমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিল। হেঁটে যাওয়ার সময়ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের ঘিরে রেখেছিল। মোটরসাইকেলে করে পাশ দিয়ে মহড়া দিচ্ছিল। একপর্যায়ে সামনে এসে ব্যারিকেড করে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ করেই সামনে যাকে পেল তাকে ধরেই পেটানো শুরু করল। ওই হামলার খবর ও ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তাই বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না।

হামলা শেষ হওয়ার পর আমরা আবার শহীদ মিনারে ফিরে আসি। সেখানে আমার সঙ্গে ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মীর কথা হয়। যেমন তারা বলেছিল, আপনারা কেন ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে এসেছেন? কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে এসেছেন, অথচ উপাচার্যের বাড়িতে হামলার সময় আপনি কোথায় ছিলেন? এখানে জামায়াত-শিবির ঢুকে গেছে। এখানে আপনারা থাকবেন না, ইত্যাদি।

তাদের জন্য আমার করুণা বোধ হলো। কারণ, তারা জানে না তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ছাত্রলীগ কেন ফ্লাইং কিক মেরে ছাত্র পেটায়? কেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিয়ে হাড় ভেঙে দেয়? কেন একটি ক্যালকুলেটরের জন্য একটা ছাত্রের চোখ কানা করে দেওয়ার উপক্রম হয়? ছাত্রকে হলের বাইরে সারা রাত দাঁড় করিয়ে রেখে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়? ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে কেন সাধারণ ছাত্র মারা যায়?

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছেড়ে দিয়েছি সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের হাতে। ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আবাসিক হল নিয়ন্ত্রণ করে। এ রকম দৃষ্টান্ত পাশের দেশ ভারতে নেই; পাকিস্তানেও নেই। আমাদের দেশে এটা সম্ভব এ কারণে যে সরকারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনে করেনি, মনে করেছে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ছাত্র ক্যাডার রিক্রুটমেন্টের জন্য ছাত্রসংগঠনগুলো হলগুলোতে ছায়া প্রশাসন গড়ে তুলেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রভোস্ট, হাউস টিউটরদের টুঁ শব্দ করার সাহস নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটা জানে, কিন্তু তাদের কিছু করার নেই। কারণ, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভু, যাদের আনুকূল্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ বিলিবণ্টন হয়, তাঁরা চান হলগুলোর প্রশাসন সরকারি ছাত্রসংগঠনের মর্জিমাফিক চলবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি ছাত্রাবাসে ধারণক্ষমতার অনেক বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী ও অছাত্র বাস করছে। চারজনের একটি কক্ষে কষ্ট করে আটজন থাকতে পারে। কিন্তু থাকছে ১৫ থেকে ২০ জন করে। সাধারণ ছাত্ররা জায়গা না পেয়ে বিভিন্ন হলের মসজিদ, রিডিংরুম, টিভিরুম এমনকি বারান্দায় বাস করছে। বিভিন্ন হল মিলিয়ে মোট ১৩টি গণরুমে ৩০ থেকে ৪০ জন করে বাস করে। ছাত্রাবাসগুলো ৬১ ভাগ সিট অছাত্রদের দখলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসে। তাদের অধিকাংশের ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ চালানো খুবই কষ্টসাধ্য। হলে জায়গা পেলে তাদের আর্থিক চাপ অনেক কমে যায়। সাধারণ ছাত্রদের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করেই চলে রাজনৈতিক কর্মী তৈরির প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীদের হলে থাকা নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রসংগঠনের নেতারা, এই প্রক্রিয়া মানসিক-শারীরিক দিক থেকে নিপীড়নমূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোকে একেকটি ‘মিনি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ পরিণত করা হয়েছে। এগুলো একেকটি রিক্রুটমেন্ট সেন্টার।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেশিশক্তি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন এই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির অংশীদার হব?

সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা আমরা দেখছি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এর একটা কারণ, এ মুহূর্তে কমিটি গঠন করা হলে যারা পদ পাবে না, তারা অসন্তোষ সৃষ্টি করবে, ফলে ছাত্রলীগের পেশিশক্তির সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হবে। কিন্তু সামনের নির্বাচনে তাদের পেশিশক্তির দরকার হবে। আমরা ছাত্রলীগকে দোষারোপ করতে পারি। কিন্তু বুঝতে হবে, তারাও ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজনৈতিক পেশিশক্তির মাধ্যমে ক্যাম্পাস দখলে রেখে জাতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের যে অশুভ প্রক্রিয়া যুগের পর যুগ চলে আসছে, তারা সেই প্রক্রিয়ার একটা ক্ষুদ্র অংশ।

যেহেতু রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাত্রসংগঠনগুলোকে নিজ স্বার্থে অপব্যবহার করেন, তাই এটা শুধু ছাত্র-শিক্ষকদের তৎপরতায় বন্ধ হবে না। ছাত্রাবাসগুলোকে ছাত্রসংগঠনগুলোর ছায়া প্রশাসন থেকে মুক্ত করতে হলে একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সিভিল সোসাইটি, সচেতন নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা-সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর আঙুল তুলে শাসানো চলতেই থাকবে, আবু বকররা গুলিতে নিহত হতেই থাকবে, হাফিজুরদের শীতের সারা রাত বাইরে থেকে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে মরতেই হবে, হাতুড়ির বাড়িতে তরিকুলদের পা ভাঙতেই থাকবে।

রুশাদ ফরিদী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক
[email protected]